এমন দেশটি…
আমার দেশটি তাকিয়ে তাকিয়ে আমার যন্ত্রণা দেখছে আজ এক যুগেরও বেশি
আমার দেশটি দেশে দেশে আমার বন্দিত্ব দেখছে, দূরত্ব বেড়ে গেলে দূ
রবীন লাগিয়ে দেখছে, বেজায় হাসছে,
পনেরো কোটি মানুষ তারিয়ে তারিয়ে ভোগ করছে আমার সর্বনাশ।
আমার দেশ এমন ছিল না আগে,
দেশের হৃদয় বলে কিছু ছিল,
দেশে মানুষ বলে কিছু ছিল।
দেশ এখন আর দেশ নেই।
কতগুলো ছবির নদী শুধু, কতগুলো গ্রাম আর শহর,
এখানে ওখানে কিছু গাছপালা, কিছু ঘরবাড়ি, দোকানপাট।
আর, ধুসর চরাচরে মানুষের মতো দেখতে কিছু মানুষ।
আমার দেশে এককালে প্রাণ ছিল খুব,
এককালে কবিতা আওড়াতো খুব মানুষ,
এখন কবিকে নির্বাসন দিতে কেউ দুবার ভাবে না,
এখন কবিকে মাঝরাত্তিরে নিশ্চিন্তে ফাঁসি দিয়ে ফেলে গোটা দেশ,
পনেরো কোটি মানুষ তারিয়ে তারিয়ে ভোগ করে মর্মন্তুদ মৃত্যু।
দেশটি ভালোবাসতে জানতো আগে,
দেশ এখন হিংসে শিখেছে, চোখ রাঙানো শিখেছে
দেশের হাতে এখন ধারালো সব তলোয়ার থাকে, দেশের কোমরে গোঁজা
মারণাস্ত্র, মারাত্মক সব বোমা,
দেশ এখন আর গান গাইতে জানে না।
দুনিয়া তছনছ করে দেশ খুঁজছি এক যুগেরও বেশি,
এক যুগেরও বেশি ঘুম নেই, উন্মাদের মতো দেশ দেশ করে দেশের কিনারে এসে
দেশকে স্পর্শ করতে দুহাত বাড়িয়ে আছি।
আর শুনি কিনা, হাতের কাছে দেশ যদি একবার পায় আমাকে,
তবে নাকি আমার রক্ষে নেই। ০৭.০২.০৮
ওই গোলাপ, ওই জল
ওই গোলাপ, ওই জল
(ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়া অনিল দত্তকে–)
একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রতিদিন এক থোকা
গোলাপ পাঠাতেন আমার কলকাতার বাড়িতে।
তিনি এ-দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন,
গণতন্ত্রের জন্য করেছিলেন,
বাক স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন তিনি,
তাঁর কাছ থেকে আমি গোলাপ পেয়েছি প্রতিদিন।
ক্ষমতার চাবুক মেরে যারা আমার মনকে
রক্তাক্ত করছে,
জীবনকে, জীবনের সব স্বপ্নকে
প্রতিদিন রক্তাক্ত করছে,
তারা শুধু আমাকে নয়,
ওই স্বাধীনতা সংগ্রামীকেও রক্তাক্ত করছে চাবুক মেরে, প্রতিদিন।
তারা জানেনা স্বাধীনতা সংগ্রামীর ওই গোলাপের রঙ রক্তের চেয়েও লাল।
এখন আর গোলাপ নয়, এখন এক ঠিকানাহীন ঠিকানায়
প্রতিদিন আমার জন্য মনে মনে চোখের জল পাঠান তিনি,
এই জল দিয়ে আমার ক্ষতগুলোর শুশ্রূষা করি।
গোলাপের স্মৃতি থেকে বিশুদ্ধ সুগন্ধ বাতাস নিয়ে
এই শ্বাসরোধ করা পরিবেশে শ্বাস নিই।
এই স্বাধীন দেশের গোপন কুঠুরিতে
পরাধীনতার শক্ত–শেকলে বাঁধা
নির্বাসিত নিঃস্ব নারী,
তাকে আজ মুক্ত করার শক্তি নেই কোনও স্বাধীনতা সংগ্রামীরও।
স্বাধীনতা হয়তো এ জীবনে আমার দূরূহই হবে পাওয়া।
ওই গোলাপগুলোকে ডাকবো স্বাধীনতা বলে,
ওই চোখের জলগুলোই আমার স্বাধীনতা।
২৮.০২.০৮
» ওরাই তাহলে পৃথিবী শাসন করুক
ওদেরই তাহলে স্বাধীনতা দেওয়া হোক,
ওদের জন্যই খুলে দেওয়া হোক অতপর অস্ত্রাগার।
তলোয়ারগুলো তুলে নিক, কোমরে গুঁজে নিক পিস্তল,
হাতে হাত-বোমা, দারুল ইসলামএর মন্ত্র মাথায় নিয়ে ওরা
না হয় বেরিয়ে পড়ুক, যেদিকে যত মুরতাদ পাক মুণ্ডু কেটে নিক।
মেয়েদের মারুক,
মেরে ফেলুক।
নতমস্তক নারীদের গায়ে বোরখা চাপিয়ে দিক,
ঘরবন্দি করুক।
ঘন ঘন পুত্র পয়দা করতে ঘরে ঘরে ধর্ষণ চলুক।
পৃথিবীর যত পুরুষ আছে, এক যোগে সবাই না হয় তালিবান হয়ে যাক,
আর্জেন্টিনা থেকে আইসল্যান্ড, মালদ্বীপ থেকে মরককো,
বাংলাদেশ থেকে বাহরাইন ওদের দখলে চলে আসুক।
ইসলামের পবিত্র জমিতে পরম শ্রদ্ধায় মাথা ঠেকাক আমাদের জননেতাগণ।
মুকুট পরিয়ে দিক এক একটা জঙ্গির মাথায়।
কৃতকর্মের জন্য করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থণা করুক জননেতাগণ।
ধর্মান্ধর পা-ধোয়া পানি পান করে পূণ্যবান হোক আমাদের জননেতাগণ।
২৪.০১.০৮
কন্যাটির কথা
কন্যাটিকে ফেলে আসতে হয়েছে কলকাতায়,
নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে বসেছিল দীর্ঘদিন,
এখনও মলিন মুখে জানালায় বসে থাকে, দিন গোনে।
শীত কাটাতে হল একা একা,
নরম লেপের তলায় আমার উষ্ণতা পেতে পেতে
এ বছর আর ঘুমোনো হল না ওর।
আমার অপেক্ষা করে ওর শীত গেল, ছুটির গরমকাল
যেন না যায়, যে-করেই হোক আমাকে ও চায়,
ফিরে পেতে চায় নিশ্চিন্তির দিন।
গড়িয়াহাট থেকে তুলে আনা শিশুটি কয়েকবছরে
ধীরে ধীরে বুকের ধন হয়ে উঠেছিল,
স্বজন বলতে এক আমিই ছিলাম ওর,
জগত বলতে এক আমিই।
আমার কিশোরী কন্যাটি তার ঘর বাড়ি, তার বিছানা বালিশ ছেড়ে
রোদ্দুরে ভেসে যাওয়া প্রিয় বারান্দাটি ছেড়ে, খেলনা-ইঁদুর ছেড়ে
মন-মরা বসে আছে স্যাঁতসেতে অন্ধকারে,
দিন-শেষে চোখ ভেসে যেতে থাকে চোখের জলে।
কলকাতা, আমাকে দাওনি, আমার নিরাশ্রয় কন্যাটিকে আশ্রয় দিও,
আমাকে রাখোনি, আমার অনাথ কন্যাটিকে দেখে রেখো।
১৭.০২.০৮
(কলকাতায় ফেলে আসা পোষা বেড়াল মিনুকে মনে করে)
কয়েক বছর
কয়েকবছর ধরে আমি মৃত্যুর খুব কাছে, প্রায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি
আমার মার সামনে, আমার বাবা, প্রিয় কিছু মানুষের সামনে বাকরুদ্ধ দাঁড়িয়ে
আছি কয়েক বছর।
কয়েক বছর ধরে আমি জানি না ঠিক বেঁচে আছি কি না,
কয়েক বছর ধরে বেঁচে থাকা এবং না থাকার ব্যাবধান কমে কমে
শূন্যে এসে সুতোর মতো নড়ছে।
কয়েক বছর ধরে আমার ভেতরে বাইরে যে মানুষটা বাস করে,
সে বীভত্স বোবা একটা মানুষ,
যার বৃক্ষ থেকে শেষ শুকনো পাতাটাও ঝরে গেছে,
জীবন থেকে জন্মের মতো বিদেয় নিয়েছে বসন্ত।
আমার যদি মৃত্যু হয় আজ রাতে, কেউ কিছু বোলো না,
শুধু কোথাও কোনও শিউলি গাছের নিচে একটা এপিটাফ পুঁতে দিও,
কয়েক বছর ধরে লেখা আমার এপিটাফ,
সাদা কাগজের গায়ে সাদা রঙে, সযত্নে লেখা এপিটাফ। ৫.১.০৮