আমার কলকাতার বাড়ি
বাড়িটা তুই, আছিস কেমন?
তোর বুঝি খুব একলা লাগে?
আমারও তো, আমারও খুব।
রাত্তিরে কি ভয় করে না?
জানলাগুলো হঠাৎ করে
ধরাস করে খুলে গেলে?
কেউ এসেকি দরজা নাড়ে?
ধুলোয় ধুসর ঘরবারান্দায় কে
উ ঢোকে কি, ভয় জাগে যে?
চোর ডাকাতের বাড় বেড়েছে!
নাকি হাওয়াই ঢোকে, ঝড়ো হাওয়া!
হাওয়াই বা কোথায় এখন,
সম্ভবত আমিই ঢুকি,
মনে মনে আমিই বোধহয়।
হেঁটে বেড়াই ঘরগুলোতে,
অন্ধকারে চিনতে পারিস!
পায়ের আওয়াজ বুঝিস কিছু?
বাড়িটা তুই, লেখার ঘরটা দেখে রাখিস,
সবকিছুই তো ওই ঘরে রে,
জীবনটাই লেখার জীবন,
ন-আলমারি বইপত্তর,
লেখাপড়ার দুনিয়াটা,
ওসব ছেড়ে ভালো থাকি!
মনে মনে আমিই বোধহয়
অশরীরি ঘুরি ফিরি
ফেলে আসা ঘরদুয়ারে
চোখের জল ফেলে আসি!
বারান্দার গাছগুলোতে
জল যে দেবে, কেউ তো নেই!
চোখের জলে বাঁচবে না গাছ?
চোখে আমার এক নদী জল,
এক সমুদ্র চাস যদি বল, পাঠিয়ে দেব,
বাড়িটা তুই, বেঁচে থাকিস।
তোকে ছাড়া নির্বাসনে
এক মুহূর্ত মন বসে না,
বেড়ালটাও বাড়ি নেই,
খাঁ খাঁ করছে বাড়ির ভেতর,
ধুলোয় তুই ডুবে আছিস,
আঁচল দিয়ে মুছে দেব,
চোখের জলে ধুয়ে দেব,
অপেক্ষা কর, বাড়িটা তুই।
তুই কি আর শুধুই বাড়ি।
তুই তো আমার হারানো দেশ।
তুই তো আমার মাতৃভাষা।
তুই কি আর শুধুই বাড়ি!
এক যুগেরও বেশি সময়
বুকের ভেতর তোকে লালন
করেছি তুই জানিস তো সব।
দীর্ঘকালের স্বপ্ন তুই,
স্বপ্ন বলেই তোকে ডাকি,
বাড়িটা তুই, বেঁচে থাকিস,
আমায় একটু বাঁচিয়ে রাখিস।
২২.০২.০৮
আমার বাংলা
আমার বাংলা আর বাংলা নেই,
সোনার বাংলা এখন ক্ষয়ে যাওয়া,
আমার রূপোলি বাংলার গায়ে মরচে,
পূর্ব পশ্চিম আজ একাকার।
ধর্মান্ধরা ছড়ি ঘোরায়, ভীতুরা মাথা নত করে হাঁটে,
নিশ্চিতই কবন্ধের যুগ এই যুগ।
সাহস আর সততার নির্বাসন হয়ে গেছে,
বাংলা এখন কুচক্রিশাসক আর তাবেদারে ঠাসা,
বাকিরা নির্লিপ্ত, জীবনযাপনকারী, হয় জড়, নয় জঞ্জাল।
এই বাংলার জন্য যত জল আমার দুচোখে আছে দিলাম,
কোনওদিন একদিন যেন উর্বর হয় মাটি, যেন জন্ম নেয় মানুষ,
যেন দুর্ভাগা-বাংলা মানুষের বাসযোগ্য হয় কোনওদিন একদিন।
১১.০১.০৮
আমার শহর নয়
আমার শহর যাকে বলেছিলাম, সেশহর আমার নয়
সেশহর ধুরন্ধর রাজনীতিক, অসৎ ব্যবসায়ী, আর নারী-পাচারকারীর শহর।
বেশ্যার দালালের শহর, লুম্পেনের শহর। ধর্ষকের শহর এ শহর।
আমার শহর নয়, সে শহর কেউ খুন বা ধর্ষিতা হলে, অত্যাচারিত হলে কিছু–
যায়-আসে-না-দের শহর।
আমার শহর নয়, সেশহর মুখে-এক-মনে-আরেকদের শহর।
বস্তির না-খাওয়াদের পাশদিয়ে নির্বিকার হেঁটে যাওয়াদের শহর,
ফুটপাথে মরে-থাকা-ভিখিরিকে আলগোছে ডিঙিয়ে যাওয়াদের শহর।
বিপদের আঁচ পেলে তড়িঘড়ি গা-বাঁচানোদের শহর।
অন্যায়ের স্তুপে বসে মুখ-বুজে-থাকাদের শহর। আমার নয়।
ইহ-আর-পরলোক-নিয়ে-পুঁদ-হয়ে-থাকাদের শহর, জ্যোতিষির শহর,
আখের-গুছোতে-ব্যস্ত-থাকাদের শহর, সুযোগসন্ধানীর শহর।
সে শহর আমার শহর নয়। কিছুতেই।
সে মিথ্যুকের শহর। কূপমণ্ডুকের শহর। ঠগ, জোচ্চোরের শহর,
আমার নয়। সে শহর সুবিধেবাদীর, স্বার্থান্ধর, পাঁড় ধর্মান্ধদের শহর।
তাদের শহরে আমরা গুটিকয় মুক্তচিন্তার মানুষ,
কিছু যুক্তিবাদী, প্রতিবাদী, কিছু সৎ, সজ্জন বড় ভয়ে ভয়ে বাস করি।
২১.০১.০৮
আমি ভালো নেই, তুমি ভালো থেকো প্রিয় কলকাতা
ভালো নেই আমি, এভাবে কেউ কোনওদিন ভালো থাকেনি কোথাও।
এভাবেই তুমি আমাকে রেখেছে কলকাতা, এভাবেই নির্বাসনে,
এভাবেই একঘরে করে। এভাবেই অন্ধ কূপে।
পায়ের তলায় পিষছে প্রতিদিন, প্রতিদিন পিষছো পায়ের তলায়।
গলা টিপে ধরেছো কথা বলেছি বলে,
হাত কেটে নিয়েছো লিখেছি বলে।
কাউকে হত্যা করিনি, কারও অনিষ্ট করিনি, কারও দিকে পাথর ছুঁড়িনি,
মানবতার পক্ষে কিছু অপ্রিয় সত্য উচ্চারণ করেছি বলে
আমাকে তোমার পছন্দ নয়।
আমাকে উৎখাত করেছে আমার মাতৃভাষা থেকে,
উৎখাত করেছে আমার মাটি ও মানুষ থেকে,
উৎখাত করেছো জন্ম-জন্মান্তরের ইতিহাস থেকে,
উৎখাত করেছো ঘর বাড়ি বাসস্থান থেকে,
পৃথিবীতে আমার সর্বশেষ আশ্রয় থেকে।
আমি ভালো নেই তাতে কী!
তুমি ভালো থেকো,
তুমি বড় বড় কবির শহর,
সাহিত্যিকের শহর,
দার্শনিক শুভবুদ্ধির শহর,
ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রগতিশীল শহর তুমি, কলকাতা,
তুমি তো সংস্কৃতির পীঠস্থান, কলকাতা, তুমি ভালো থেকো।
তুমি সুখে থেকো প্রিয় কলকাতা,
নাচে গানে থেকো, উৎসবে আনন্দে, মেলায় খেলায় থেকো সুখে।
তুমি তো মহান, তুমি বিরাট, তুমি অট্টহাসি হাসো, জগত দেখুক।
২৮.০২.২০০৮
আশা দিও
আশাগুলো একটু একটু করে
চোখের জলের মতো টুপটাপ ঝরে পড়ছে,
আশাগুলোকে উড়িয়ে নিচ্ছে নিরাশার লু হাওয়া।
এই কঠোর নির্বাসনে
স্বজন বন্ধু থেকে বিচ্ছিন্ন।
কোনও অপরাধ না করে আমি অপরাধী,
যে কোনও মুহূর্তে মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হবে।
একটু আশার আশায় সারাদিন বসে থাকি,
কোনও ফাঁক ফোকড় দিয়ে যদি ভুল করেও ঢোকে।
সারারাত জেগে থাকি, ধুলোর ওপরও উপুড় হয়ে
আশা বলে কিছু যদি আচমকা চিকচিক করে, খুঁজি।
কিছু নেই।
জীবন পেতে আছি,
পারো তো কিছু আশা দিও,
সামান্য হলেও ক্ষতি নেই, দিও।
মিথ্যে করে হলেও দিও, তবু দিও।
২৩.০২.০৮