ওদের ইচ্ছে তুমি উন্মাদ হও,
স্নায়ুতন্ত্রে যদি খুব শক্তি ধরো, উন্মাদ হতে যদি না-ই পারো,
তবে দেশ ছাড়ো, যে করেই হোক ছাড়ো, এ দেশ তোমার নয়।
মাটি কামড়ে কতদিন কে-ই বা পড়ে থাকতে পারে।
এত ঘৃণা, এত থুতু, এত লাথি
কতদিন সইতে পারে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখা মানুষ।
ওরা চাইছে, উন্মাদ যদি না-ই হও, দেশ যদিনা-ই ছাড়ো,
অন্তত মরো।
তুমি সাফ কথা জানিয়ে দিয়েছে গতকাল,
যা হয় তা হোক, আপাতত কোনওটিরই সম্ভাবনা নেই।
কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিনীত কণ্ঠে বলেছে, দিনে দিনে তোমাকে
অসম্ভব সহিষ্ণু করে গড়ে তোলার পেছনে অবদান ওদেরই।
এখন আগুনে পোড়ালেও তুমি পুড়ে পুড়ে আর
দগ্ধ হবেনা, বড়জোর যদি কিছুহও ইস্পাত হবে।
১৯.০২.০৮
সিসিইউ থেকে সিসিইউ
সিসিইউ থেকে সিসিইউ
(করোনারি কেয়ার ইউনিট থেকে কলকাতা)
বাড়িঘর ছেড়ে,
প্রিয় বেড়াল ছেড়ে, বইপত্র, বন্ধুদের ছেড়ে,
নিজের জীবন ছেড়ে,
অনিশ্চয়তার বোঁটকা-গন্ধ-কাঁথায় মুখ-মাথা ঢেকে,
দিনের পর দিন পড়ে থাকা
কোথায় পড়ে থাকা কতদিন কিছুই না জানা
হৃদপিণ্ডকে দাঁতে নখে কামড়েছে ভীষণ।
তারপর তো হৃদয় স্তব্ধ হলে অগত্যা সিসিইউ।
যায় যায় জীবনকে কোনওমতে টেনে আনা হল,
ধুকধুক বুক ফিরে যেতে চায়, রুগ্ন শরীর ফিরে যেতে চায় ঘরে।
বেড়ালের কাছে, বন্ধুর কাছে, স্পর্শের কাছে প্রিয়,
সিসিইউ থেকে সিসিইউ যায় মন….!
কে আর তোয়াককা করে হৃদয়ের!
সিসিইউ থেকে তুলে নিয়ে তাকে শোনানো হল
বড় গম্ভীর, গাঁ কাঁপানো স্বর, অন্য কোনও দেশে চলে যাও, এ-দেশ ছাড়ো।
কোথায় যাবো, কোথাও তো যাওয়ার নেই আর, মরলে এ মাটিতেই মাটি দিও,
মাটি খুঁড়ে দেখতে চাও তো দেখে নিও আমার শেকড়।
কারই বা কী দায় পড়েছে দেখার,
কারই বা দায় পড়েছে চোখের জলে ভেসে যাওয়া মানুষের
কাতরানো দেখে কাতর হওয়ার!
সিসিইউ থেকে আবার নির্বাসনে,
আবার অন্ধকারের গায়ে আবর্জনার মতো ছুঁড়ে
হাত ধুয়ে বাড়ি চলে গেলেন ওঁরা, ওঁরা খুব বড় বড় লোক,
হাতজোড় করে নতমস্তকে নমস্কার করি ওঁদের। ০৩.০২.০৮
সেইসব দিন ১
আমাকে কোনও একদিন
কোনও বরফের দেশে, নির্বাসনে পাঠাবে ভারতবর্ষ।
জমে যেতে যেতে একটু তাপ চাইবো, সামান্য উত্তাপ,
দূর পরবাসে কে আছে যে দেবে কিছু!
স্মতিই যদি একমাত্র বাঁচায় আমাকে।
সেইসব দিনই যদি উত্তাপ দেয়, দেবে।
আমার মধ্য কলকাতার আকাশ ছাওয়া
বেড়াল-বেড়াল–বাড়িটাতে,
বিকেল বেলা সুস্মিতা আসতেন কিছু না কিছু নিয়ে,
কোনওদিন রাবড়ি, কোনওদিন ধনে পাতার আচার।
গল্প বলতেন জীবনের, পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে কী করে তিনি তিনি হলেন।
স্বাতী স্বপ্নার তুমুল তারুণ্য, উরি উচ্ছাস,
ঢোলের মতো বাজতো ঘরদোরে।
শর্মিষ্ঠা নামের মেয়ে কত কত কবিতা আওড়ে
সন্ধ্যেগুলো উজ্জ্বল করেছে।
বড় ভালোবেসেছিল শর্মিলা, বড় স্বজন ছিল শর্মিলা।
বর্ধমান থেকে জয়প্রকাশ চলে আসতেন,
হাতে সীতাভোগ, হাতে মিহিদানা, মুখে সলজ্জ সম্ভাষণ।
হঠাৎ উদয় হয়ে সকৌতুকে জীবন বলতো রঞ্জন।
সুমিতাভে মগ্ন হওয়া সেই তীব্র বর্ষাগুলো।
আর সেইসব সুব্রতময় দিন।
বরফে জমতে থাকা আমার শীতার্ত নির্বাসনে
সেইসব দিনই যদি উত্তাপ দেয় দেবে।
জঙ্গিপুর থেকে গিয়াসউদ্দিন আসতেন,
চব্বিশ পরগনা থেকে মোজাফফর,
আমাদের চোখের সরোবরে স্বপ্ন সাঁতার কাটতো,
অবিশ্বাস্য সব সুন্দরের স্বপ্ন।
দেশ থেকে দাদা আসতো একতাল শৈশব নিয়ে,
কাঁধে করে উঠিয়ে আনতে দেশের বাড়ি,
দাদার গা থেকে গন্ধ বেরোতো হাসনুহানার।
হাসনুহানার ওই গন্ধই যদি উত্তাপ দেয়, দেবে।
দূর পরবাসে জমে জমে বরফ হতে থাকা
আমাকে কে বাঁচাবে আর,
যদি স্মৃতিই না বাঁচায়।
০৭.০৩.০৮
সেইসব দিন ২
বিখ্যাতদের সঙ্গে ওঠাবসা আমার কখনও ছিল না।
নামী নামী লোকেরা আমার আশেপাশে
খুব একটা ঘেসেনি কোনওদিন, অথবা সন্তর্পনে আমিই
দূরে দূরে থেকেছি ভয়ে বা সংকোচে।
আমার মতো করে তাই বাস করতে পারতাম শহরে,
আমার মতো করে মাটিতে মাটির মানুষের সাথে।
সহজ সাধারণরাই সাধারণত আমার স্বজন,
বাজারের ঝাঁকাওয়ালা, তরকারিওয়ালা,
মাছ কাটার টগবগে ছেলেরা, মাছওয়ালা,
চায়ের দোকানের বেজায় ভদ্রলোকটি
ধনঞ্জয় ধোপা,
আর সেই মল্লিকপুর থেকে আসা মঙ্গলা,
সোনারপুরের সপ্তমী,
এদের ছেড়ে কোথায় কার কাছে যাবো?
ওদিকে দুর্গা প্রতিমার মতো মুনা,
কল্যাণী থেকে ছুটে আসা গার্গী,
মানসী মেয়েটির ওই একবার ছুঁয়ে দেখতে চাওয়া,
ছেড়ে কোথায় কোন নির্বাসনে যাবো আমি?
উঠোনের ঘাসে ফুটে থাকা মনকাড়া ফুল,
মালিদা মালিদা, ও ফুলের নাম কী?
একগাল হেসে মালিদা কতদিন বলেছে,
ও ফুলের তো দিদি কোনও নাম নেই!
দিগন্ত অবধি কত মাঠ জুড়ে কত সুগন্ধ ছড়ানো
কত নামহীন ফুল,
ছেড়ে কোথায় কার কাছে যাবো?
০৭.০৩.০৮
স্বাধীনতা
অভিজ্ঞতার জন্য সবার অন্তত এক বার
নির্বাসনের জীবন ভোগের প্রচণ্ড দরকার।
পরাধীনতার কিছুনা পোহালে স্বাধীনতা কী জিনিস
কী করে বুঝবে, কেই বা বুঝবে! মর্যাদা দেবে কেন?
স্বাধীনতা পেতে লড়াই করছি শৈশব থেকে প্রায়,
আমি বুঝি এর গভীর অর্থ, আবশ্যকতা কত।
জীবন দেখেছি বলে প্রাণপণে জীবন ফেরত চাই
অনেকের মতো নাহলে নিতাম পরাধীনতায় ঠাঁই।