ওভাবে সে চুমু খেতে না চাইলে অত করে ভালোবাসতে চাইতাম বুঝি!
ওভাবে দাঁড়িয়ে না থাকলে আঁকড়ে ধরতাম বুঝি
অত শক্ত করে পায়ের আঙুলে মাটি?
ঠেকিয়ে রাখতাম পিঠ দেয়ালে? খামচে ধরতাম হাতের কাছে যা পাই?
ওভাবে আমাকে নাগাল পেতে বাড়িয়ে না দিলে হাত,
পাড়াপড়শি গ্রাম শহর নগর বন্দর জাগিয়ে উত্তরে দক্ষিণে
উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োতাম না জীবনের খোঁজে।
ওভাবে যদি না দাঁড়িয়ে থাকতো মৃত্যু দরজায়,
একবারও চাইতাম না তাকে ঠেলে সরাতে,
পালাতে চাইতাম না কোথাও, বরং চরাচর খুঁজে তাকেই বাড়ি নিয়ে এসে
বসতে দিতাম।
লং লিভ ডিমোক্রেসি
হঠাৎ বিকেলবেলা তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেল ওরা,
যারা হুমকি দিচ্ছিল বাড়ি ছাড়ো, শহর ছাড়ো, রাজ্য ছেড়ে চলে যাও
কোথাও,
সবচেয়ে ভালো হয় যদি দেশ ছেড়ে চলে যাও খুব দূরের কোনও দেশে।
হতভম্বের মতো বসে ছিলো, মাটি কামড়ে পড়ে ছিলো মাসের পর মাস,
কোথাও যায়নি।
বাড়ি না ছাড়লে বাড়িতেই পচে মরো, এরকম শাসিয়ে যেত রাজার
লোকেরা,
চৌকাঠ ডিঙোতে দেয়নি তাকে, মাসের পর মাস।
শহর জুড়ে কত কিছু নিয়ে প্রতিবাদ, উৎসব শহর জুড়ে
ঝাঁক বেঁধে মানুষ হাঁটছে কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা,
শহরে তখন একজনের পায়ে শেকল,
কথার চেঁচামেচি চারদিকে,অথচ ওদিকে
একজনের মুখে আতঙ্কের জঞ্জাল ঠেসে মুখ বন্ধ করে দেওয়া।
রাজা তখন নন্দনকাননে মৃদুমন্দ হাওয়ায় দোলেন।
নিষেধাজ্ঞা জারি আছে মাথা থেকে পায়ের নখে,
মাথা অচল করে দাও, অচল না পারো ভোঁতা করে দাও।
চোখ বন্ধ করে রাখো, যেন কিছু দেখতে না হয়,
নাক টাকও বন্ধ রাখো, যেন কিছু শুঁকতে না পারো,
মুখ বন্ধ করে রাখো, যেন মুখ ফসকে কিছু বেরিয়ে না আসে,
বুকের মধ্যে কিছু রেখো না, হৃদয় শূন্য করে দাও।
কোমর, পেট, তলপেট, উরু অবশ করে রাখো,
চলৎশক্তিহীন করে রাখো পা। মাসের পর মাস।
ওভাবেই পড়ে ছিল সে, মাটিকে ভালোবেসে মাটির মতো, মৃতবৎ।
অবশেষে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে রাজ্যছাড়া করা তাকে হলই,
বেঁচে থাকার বেদম ইচ্ছেকে তুলে নিয়ে আবর্জনায় ফেললা হলই,
স্বপ্নটপ্ন ইত্যাদি ফালতু যা ছিল দাউদাউ করে পোড়ানো হল। হলই।
লোকচক্ষুর সামনেই হল।
একটি বাক্যই সে এখন গুহার ভেতরে, অন্ধকারে, দূরে, নিশ্ছিদ্র
নিরাপত্তার মধ্যে বলে,
পুরো ভারতবর্ষকে শুনিয়েই বলে, লং লিভ ডিমোক্রেসি।
লোকগুলো, তোরা
ঘরের লোকটা ঠকাচ্ছে, প্রতিদিন,
পাশের বাড়ির লোক এমনকী দূরের বাড়ির লোকও ঠকায়
ঠকানো জলের মতো সোজা তোকে।
নরম গলায় যেই না কথা বললো কেউ,
কাঁধে নরম একটা হাত রাখলো,
বুকে বা চুলে আঙুল চালালো,
ঠোঁটের সর্বনাশ করে চুমু খেল, অমনি তুই
প্রেম ভেবে নেচে উঠিস।
হাতে রাখতে তোকে কিছু খেতে পরতে দেয়,
নাকে নোলক দেয়, পায়ে নূপুর দেয়,
নরক দেয়,
গর্ভ উপচে দেয়, গর্ব দেয়,
বংশের বাতি দেয়, লাথি দেয়,
একে ভালোবাসা ভেবে পুলক হয় তোর,
যা আছে সব দিয়ে থুয়ে নিঃস্ব হয়ে যাস।
ঘর থেকে বেরোলেও ওই একই গল্প
এক শরীর মাংস তুই, এক মাথা আবর্জনা,
তোকে বধু করে, বোন করে, তোকে মা করে, মেয়ে করে
আগলে আগলে রাখতে হয়, না হলে পচে যাবি
না হলে মরণ হবে।
তোর তো আসল মরণ এভাবেই ,
যেভাবে বেঁচে আছিস!
অস্তিত্বের অস্থিমজ্জা খুইয়ে,
ব্যক্তি নেই, অভিব্যক্তি নেই, মুর্খলোকে বাস,
লোকের তুই দাসানুদাস!
কে বলে তুই কিছু না,
স্তন তুই,
যোনী তুই,
জরায়ু তুই,
এই বর্ণময় অর্থময় জগতে এক জীবন পরাজয় তুই।
তোকে ততদিন আমি এভাবে ধিককার দেব
যতদিন ঠকতে থাকবি,
যতদিন মাথা নুয়ে থাকবি,
যতদিন কেঁচো হয়ে থাকবি,
যতদিন চোখের জল ফেলবি।
ততদিন ধিককার আমি দিতেই থাকবো
যতদিন কেড়ে না নিবি ,
যতদিন রুখে না উঠবি,
যতদিন লাথির বদলে লাথি না দিবি,
যতদিন মানুষ না হবি।
শহরের প্রেমিক
এক প্রেমিক ছিল আমার খুব কাছেই কোথাও, জানা ছিল না।
ভেবেছিলাম এ শহরে বুঝি কেউ কাউকে ভালোবাসে না, বুঝি শহরটা
এমনই,
সন্ধে হতেই ঢুকে পড়ে শুঁড়িখানায়, রাত গভীর হলে
টলতে টলতে বাড়ি ফেরে, ফিরে বউকে ধমকায়,
শহরটা পুরুষের মতো পুরুষ, কুৎসিত।
কিন্তু এই ভ্যাপসা গরমের, এই ধুলোর, আবর্জনার,
থুতুর শহরে কেউ ভালোবাসে কাউকে।
যখন রাজনীতিকরা ছল চাতুরি করে, যখন ব্যবসায়ীরা ঠকায়,
যে কেউ যে কাউকে সুযোগ পেলেই ধাককা দেয়,
ছিনতাই করে পালায়, যখন ধর্ষণ করে যুবতী কিশোরী এমনকী শিশু,
যখন খুন করে ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ মানুষকে
তখন এ শহরেরই কোথাও কেউ কাউকে খুব গভীর করে
ভালোবাসছে,
ভালোবাসতেবাসতে কাঁদছে।
বেদনা ছিঁড়তে থাকে তাকে, হৃদয়ে ক্ষরণ দিনমান,
ভালোবাসতে বাসতে চলন্ত ট্রেনের তলায় গলা পেতে দেয়
ঢিলের মতো ছুঁড়ে দেয় নিজের জীবন, সাধস্বপ্নসহ ভবিষ্যত।
প্রেমিকের কবরে তাজা তাজা গোলাপ দিই মনে মনে,
হাঁটু গেড়ে বসে বাকি জীবন প্রেমের পাঠ নিই মনে মনে।
সে নেই। তার প্রেম ওড়ে হাওয়ায় হাওয়ায়। শহরকে শুদ্ধ করে।
কাছ থেকে দেখতে ইচ্ছে করে তেমন একটি প্রেমিক।
একটুখানি ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে তেমন একটি মানুষ।
শিউলি
আশ্চর্য একটা গাছ দেখি পথে যেতে যেতে, যে গাছে সারা বছর শিউলি
ফোটে।
গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখে জল উপচে ওঠে,
শিউলি পড়ে শীত গ্রীস্ম বর্ষা সাদা হয়ে থাকে মাঠ।
তার কথা মনে পড়ে, শিউলির মালা গেঁথে গেঁথে
শীতের সকালগুলোয় দিত,
দুহাতে শিউলি এনে পড়ার টেবিলে রেখে চলে যেত।
শীত ফুরিয়ে গেলে দীর্ঘ দীর্ঘ শ্বাস ফেলতো তাকে মনে পড়ে।
একবার যদি দুনিয়াটা এরকম হতে পারতো যে নেই সে আসলে আছে,
একবার যদি তাকে আমি কোথাও পেতাম, কোনওখানে,
তার সেই হাত, যে হাতে শিউলির ঘ্রাণ এখনও লেগে আছে,
এখনও হলুদ জাফরান রং আঙুলের ফাঁকে, ছুঁয়ে থাকতাম,
মুখ গুঁজে রাখতাম সেই হাতে।
সেই হাত ধরে তাকে নিয়ে যেতাম নতুন গাছটার কাছে,
মালা গেঁথে গেঁথে তাকে পরাতাম, যত ফুল আছে তুলে
বৃষ্টির মতো ছড়াতাম তার গায়ে।