চাওয়াগুলো
পাহাড়গুলো জড়ো করলে যে পাহাড় হবে,
সাগরগুলো মিশিয়ে দিলে যে সাগর হবে –সেরকম কিছু ইচ্ছে করে।
শেষ হতে না চাওয়া আকাশের মতো কিছু।
তোমাকে ছুঁলেই তুমি ফুরিয়ে যাও,
মনের তো নয়ই , যে আঙুলে ছুঁই, সেটিরও কিছু মেটেনা।
তিয়াশ মেটাবো বলে যার তার কাছে যাই, সে কি আজ থেকে!
মেটেনি কোনওদিন।
আমাকে জড়ো করে করে যে আমি হই, তাকে পুড়িয়ে ছাই করে
তুমি বিখ্যাত হলে।
এক দুই করে করে অনেকগুলো বছর
তোমাকে জড়ো করে করে তোমাকে পাইনি,
স্পর্শের আগেই ভেঙে গেছ, চুম্বনের ঢের আগেই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে
জানি না তোমার কোন ঈশ্বরের দিকে উর্ধ্বশ্বাসে উড়েছো।
তোমাকে চাওয়া তো শুধু তোমাকেই চাওয়া নয়।
চাওয়াগুলো পাওয়ার আড়ালে ঘাঁপটি মেরে থাকে
পাতার আড়ালের পোকার মতো।
চাওয়াগুলো চিবিয়ে খায় আমাকে, চাওয়াগুলোকে গিলে ফেলি আমি
ভয়ে।
ঝরাপাতা
ঝরাপাতাদের জড়ো করে পুড়িয়ে দেব ভেবেছি অনেকবার,
রাত হলেও যত রাতই হোক, আগুন হাতে নিই।
ওদের তাকিয়ে থাকা দেখলে গা শিরশির করে।
ঝরে গেলে কিছুর আর দায় থাকে না
যেমন খুশি ওড়ে, ঘরে বারান্দায় হৈ হৈ করে খেলে,
জানালায় গোত্তা খাচ্ছে, গায়ে লুটোপুটি, হাসছে,
কানে কানে বার বার বলে, ঝরে যাও, ঝরো, ঝরে যাও।
মন বলে কিছু নেই ওদের। তারপরও কী হয় কে জানে, আগুন নিভিয়ে
দিই।
পাতাগুলো পোড়াতে পারি না, কোনও কোনও দিন হঠাৎ কাঁদে বলে
পারি না,
গুমড়ে গুমড়ে কারও পায়ের তলায় কাঁদে।
কান্নার শব্দ দিগন্ত অবধি ছড়ানো শত শতাব্দির মরুময় নৈঃশব্দ
ভেঙে ভেঙে জলতরঙ্গের মতো উঠে আসে..
কেউ হেঁটে আসে, আমার একলা জীবনে কেউ আসে।
সে না হয় দুদণ্ড দেখতে এল, তবু তো এল।
সে না হয় কাছেই কোথাও গিয়েছিলো, তাই এল, তবু তো এল।
ঝরাপাতারা তাকে নিয়ে নিয়ে আসে, যতক্ষণ নিয়ে আসে,
ততক্ষণ জানি আসছে, ততক্ষণ নিজেকে বলি কাছেই কোথাও নয়, পথ
ভুল করে নয়,
আসলে আমার কাছেই, বছরভর ঘুরে, ঠিকানা যোগাড় করে, খুঁজে
খুঁজে
আমার কাছেই আসছে কেউ, ভালোবেসে।
ওই অতটা ক্ষণই, ওই অতটা কুয়াশাই
আমার হাত পা খুলে খুলে , খুলি খুলে, বুক খুলে গুঁজে দিতে থাকে প্রাণ।
বাড়ির চারদিক পাহাড় হয়ে আছে ঝরাপাতার,
পোড়াতে পারি না।
ডুবে যেতে থাকি ঝরাপাতায়, পোড়াতে পারি না।
দ্যুতি
(আন্দ্রিয়া ডোরকিন্সকে)
সূর্য কি কখনও কাউকে জিজ্ঞেস করে,
আমি কি যোগ্য, আমি কি যথেষ্ট?
করে না, সে বরং আলো ছড়িয়ে যায়।
সূর্য কি কখনও কাউকে জিজ্ঞেস করে,
চাঁদ কী ভাবছে আমাকে নিয়ে?
আজ কি মঙ্গল কিছু বলেছে আমার কথা!
না, সে আলো ছড়িয়ে যায়।
সূর্য কি কখনও কাউকে জিজ্ঞেস করে,
ব্রহ্মাণ্ডের অন্য সূর্য়গুলোর মতো কি আমার আকার?
না, সে আলো ছড়ায়।
তুমিও কোনওদিন কিছু জানতে চেওনা মেয়ে,
তোমার অহংকারের আলো যখন
তোমার মুখে এসে পড়বে,
মুখটি দেখো আয়নায় দাঁড়িয়ে,
ওই উজ্জ্বল, ঝলমলে মুখটি তোমার মুখ,
মুখটিতে ভালোবেসে চুমু খাবো আমি।
প্রথম দিন
বছরের প্রথম দিনটি যে কোনও দিনের মতোই দিন,
যে কোনও দিনের মতোই এর সূর্যচাঁদ,
এর আকাশ আর মাটি, এর সমুদ্র ঝাউবন,
ধুলোবালি, গৃহস্থালি,
যে কোনও দিনের মতো উদাসিন এই দিন।
মধ্যরাতে মদ্যপান আর আকাশ লাল করা হুল্লোড়,
ঝেঁটিয়ে জীর্ণ পুরোনোকে ঘরবার, অমনি সে ভ্যাঁ,
উঠোন ভিজিয়ে হিসি।
নতুনের কোলে কাঁখে আহলাদী বুড়োর মতো বাপ বাপ বলে ঝাঁপ।
কেউ কেউ বাণিজ্য ব্যস্ততায় বুঁদ।
কেউ আবার হতচকিত, জানে না আজ কী দিন, কোন দিন,
ঢোঁড়াসাপের মতো চোখের সামনে পুরো দিন পার হয়ে গেলেও
অনেকে জানবে না আজ প্রথম দিন বছরের।
সাল তারিখের খবর কজন জানে?
সখিনা বিবি জানে? ফুলমণি দাসী?
পাখি কি জানে? পাতা জানে আজ নিউইয়ার? ফুল জানে?
নিউইয়ার বোঝো?
পোষা বেড়ালটি এত যে সভ্য ভব্য, বললো বোঝে না।
কে বোঝে তবে, আমি!
আঙুলের ফাঁক গলে শৈশব থেকে দিনগুলো ঝরে যাচ্ছে টের পাচ্ছি,
বুঝতে না দিয়ে মাসগুলো ঝরছে, নির্লজ্জের মতো বছর,
মাঝে মাঝে দিনের শেষে একা অন্ধকারে থমকে দাঁড়িয়ে ভাবি,
মৃত্যুর দিকে কি যাচ্ছি না একটি বছর করে প্রতিবছর?
এক জীবন শূন্যতার দিকে প্রতিবছর?
নেই নেই হাহাকারের দিকে প্রতিবছর?
বছর যায় আর টুপ করে এক একটি আশঙ্কা এক টুকরো খড়ের মতো
বুকের মধ্যে ঢুকে যায়, সময় নেই। নেই ।
ইচ্ছে করে, কার না করে, ঝুঁটি ধরে সময়কে বসিয়ে দিই বারান্দায়,
শুইয়ে দিই, সুড়সুড়ি দিয়ে ঘুম ভাঙাই, বেড়াতে যাই পুকুরপাড়,
দুধকলা দিয়ে পুষি, ভুলিয়ে ভালিয়ে মুঠোর ভেতর নিয়ে নিই,
ইচ্ছে করে শেকল দিয়ে বাঁধি। আর যেন কোনওদিন কখনও
সে না যায় আমাকে ছেড়ে, কোথাও এক পা-ও ।
এসব ইচ্ছের কথা, কবে আর কখন পুরন হয়েছে!
ইচ্ছেরা ইচ্ছেই থেকে যায় হাজার বছর।
এখনও কখনও তারিখ লিখতে গেলে ভুল করি,
অন্যমনে সাল লিখে ফেলি ছিয়াশি বা ছিয়াত্তর
তবে কি অবচেতনে মন পড়ে থাকে পুরোনোতে! কেবল শরীর
এগোয়!
পাক ধরে চুলে বা চামড়ায়, হাড়ে বা ঘাড়ে বছর বছর!
আর মন খেলে নিরালাদের বাড়ির মাঠে এখনও হাডুডু, এখনও
গোল্লাছুট!
মন কেবল পেছনে নয়, সামনে আলোর গতিতে যেতে পারে,
যত দূরে ইচ্ছে যায়, তত দূরে। মনের গায়ে শেকড় নেই, শেকল নেই,
শ্যাওলা নেই।
পেছনে আনন্দ, পেছনে শৈশব, সামনে কিছুই না, কিছুই না,
একটি শীর্ণ জীর্ণ নদী, আর তার পাড়ে অনেকগুলো বছর কাঁথা মুড়ে
জবুথবু বসে আছে, ঝিমোচ্ছে, গায়ে পায়ে জং।
মন এখন আকাশ চায়।
নতুন বছর মনকে ছুঁতে পারে না, শরীরকে ছোঁয়,
পেটে গুঁতো মেরে বলে যায় ডাকো বা না ডাকো
দেখা হবে নদীর পাড়ে। দেখা হবে কাঁথা আর জবুথবু জীর্ণতার পাড়ে।
দেখা তো হবেই। শরীরের শক্তি নেই না দেখা দেবার।
মন চেনে না নদীর পাড়। মন এখন আকাশপাড়ে।
নিউইয়ার বোঝো? মনকে প্রশ্ন করি,
মুখ মুছে বলে দেয়, বোঝে না।
মনের নাকি দায় নেই বোঝার, মন শুধু আকাশ বোঝে,
বছর বোঝে না, বয়স বোঝে না।
শরীরকে বলি, ও শরীর বুঝিস নিউইয়ার?
বুঝি না মানে? বলে খেঁকিয়ে ওঠে, তোদের নিউইয়ার হাড়ের ভেতর
ঢুকে বুঝিয়ে দেয় ও কী জিনিস।
মজ্জায় গিয়ে মরণ কামড় দেয়,
ও তো রক্তের ভেতর বালতি বালতি বরফ ঢেলে বলে যায়, সময় নেই।
বুঝি না মানে? প্রতিবছর ভয়ে ভয়ে রাত গুনি, এই বুঝি এলো!
না এলে কী হত নিউইয়ার? ও শরীর? দিন তো পেরোতোই,
যেভাবে পেরোয়!
শরীর কথা বলে না। সময় নেই তার,
সে এখন প্যারিস যাবে।
পোষা বেড়ালটি বারান্দার রোদে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকে,
মন তার পাশে বসে ঝিমোয়। মনের ঠ্যাং ধরে টান দেয় শরীর,
যাবি চল। যাবি চল? মন যাবে না কোথাও।
যেই না কান ধরে হেঁচকা টান, অমনি সে ভ্যাঁ,
বারান্দা ভিজিয়ে হিসি।
বাড়িঘর ছেড়ে বেড়াল ছেড়ে বুনো কলকাতা ছেড়ে
মন যাবে না কোথাও।
না যাক। শরীর চলে যায় একা একা, পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে।
শরীরের পেট কয়েক দশক ধরে নতুন বছরেরা
গুঁতো মেরে মেরে ডাবিয়ে দিয়েছে, খানিকটা কাবু সে, যদিও বাবু সে।
নিউইয়ার বোঝে না শরীর, প্রেম বোঝে।
মন তুই সীমনা বুঝিস? এ দেশ ও দেশ?
না। বুঝি না।
হিংসে বুঝিস? যুদ্ধ?
বুঝি না।
মরে যাওয়া বুঝিস?
না।
তবে বুঝিস কী?
ভালোবাসা বুঝি।
সাদা একটি চন্দ্রমল্লিাকার গালে চুমু খেয়ে মন বলে, ভালোবাসি চল।
পাখিগুলো পাতাগুলো ফুলগুলো মনে মনে মনকে বলে,
আজ থেকে ভালোবাসি চল।
শরীরও যদি এমন বলতো, সময় ফুরোচ্ছে তাতে হয়েছে কী!
ভালোবাসি চল।
সময় তো তত ফুরোয়নি যত ফুরোলে নদীর পাড়ে কাঁথা মুড়ে বসতে হয়!
ও শরীর, সময় তো তত ফুরোয়নি, যত ফুরোলে গায়ে পায়ে জং ধরে।
ভালোবাসবি কি?
দীর্ঘ একটি শ্বাস ফেলে শরীরকে বলতেই হবে, বাসবো।
এ জিনিসটি সে জানে বেশ,
তার ঠোঁট জানে, আঙুলগুলো জানে, প্রতি কণা ত্বক জানে,
সবকটি রোমকূপ জানে, চোখ জানে।
যে কোনও দিনই যে কোনও দিনের মতো,
দিন দিনের মতো থাকে,
মানুষই দুঃখ সুখ গড়ে, মানুষের হাতে যুদ্ধ,
মানুষই খুন করে মানুষ,
মানুষই কলজে খায় রক্ত খায় মানুষের
এই মানুষই আবার নতজানু হয় মানুষের কাছে,
মানুষই মানুষ ভালোবাসে।
দিন দিনের মতো পড়ে থাকে,
মানুষই দিনকে উজ্জ্বলতা দেয়,এই মানুষই আবার দিনকে দিনের
আলোয় ধর্ষণ করে।
দিন দিনের মতো থাকে, রাত রাতের মতো।
নক্ষষন নক্ষষেনর মতো, বেড়াল বেড়ালের মতো।
সময় নেই, তাতে কী!
সময় তো মহাবিশ্বেরও নেই, কোনও একদিন চুপসে যাবে।
সহস্র কোটি গ্রহ নক্ষষন নিয়ে নিজেই নিজের উদরে,
অনন্ত বলে কিছু নেই, অতল বলে নেই।
অন্তর বলে কিছু এখনও আছে, অন্তরতর বলে কিছু।
চন্দ্রমল্লিকার গালে চুমু খেয়ে না হয় বলিই
আনবিক পারমাণবিক ছেড়ে মানবিক হই চল,
এ বছর মন দিয়ে ভালোবাসি চল।
কেবল মুখের কথায় বছরের ছাই হবে, বছর শুনেছে এমন বহুবার,
এবার ভালোবেসেই দেখাতে হবে ভালোবাসি।
কাকে ভালোবাসবো? না কোনও ধর্ষককে নয়,
কোনও শোষককে নয়, অবিবেচক অত্যাচারীকে নয়,
কোনও লোভীকে নয়, পুরুষকে নয়। মানুষকে বাসি চল।
সখিনা বিবিকে চল। ফুলমণি দাসীকে চল।