অরন্ধন
কৈশোর যেতে না যেতে সংসার শুরু তোমার
ভোর থেকে মধ্যরাত্তির গতর খাটো,
তিনবেলা রাঁধো, পাতে তুলে তুলে খাওয়াও
বাড়ির লোকদের, অতিথিদের,
এমনকী জলও ভরে দাও গ্লাসে।
ভাসো, ভেসে যাও −ঢঁকুরের টকে,
নিজে তুমি সবার শেষে।
যখন খেতে বসো, একা,
সঙ্গ দেয় বড় জোর পাড়ার নেড়িকুকুর।
সবাই বসে থাকুক খাবে বলে,
#কই গো, হল? দাও।
কি রেঁধেছো কী শুনি,
ইলিশ ভাজো, মাংসটা ভালো ভাবে কষাও,
আলু পোস্ত কর, কাসুন্দিটা দিও।
বেগুন ভাজা আছে তো! পটলের −দারমা করার কথা ছিল!
চিংড়ির কিছু করোনি! চিলি চিকেনের খবর কি? #
এসব শুনো না। কান দিও না।
এটোঁ আঁশটে বাসন থেকে দূরে সরে এসো তো,
ও মেয়ে সরে এসো,
আজ থেকে তোমার অরন্ধন শুরু হোক।
আকাশপার
তোমার পারে কি আর আজ থেকে বসে আছি!
ডেকে ডেকে চাঁদ দেখিয়েছো, নক্ষষনগুলোও সব দেখা সারা,
কী লাভ দেখে !
দেখতে তো চাই তোমাকে, তোমার ভেতর বাহির।
ওই চাঁদ সূর্য থেকে, রাশি রাশি তারা থেকে ঢের জরুরি তো তুমি,
তোমার আলোয় পুরো এক ব্রহ্মাণ্ডকেই দেখতে চেয়েছি,
তোমার আলোয় তোমাকে চেয়েছি, আমাকেও।
আমার চাওয়াটির গায়ে অনেকদিন আগুন ধরিয়ে দিয়েছো
চাওয়াটি এখন ডানা-ভাঙা চড়ুইএর মতো আকাশপারে
চাওয়াটির দিকে চাইলে জল চলে আসে চোখে
এ চাওয়াকে কে চায় আর !
আকাশ তুমি নিরুপদ্রপ বাস করো তোমার ব্ল্যাক−হালে,
হৃদয়ে অন্ধকার পুরে বসে থাকো চুপচাপ।
তোমার বাড়িঘর আরও ভগবানে
আরও ভবিষ্যতে, আরও ভুতে ভরে উঠুক,
আকাশ তুমি নিজের সঙ্গে প্রেম করো বাকি জীবন,
আকাশ তুমি একা একা সুখে থাকো বাকি জীবন।
আমি, আমরা সবাই, খুবুব বুড়ো হয়ে যাচ্ছি
খুব বুড়ো হয়ে যাচ্ছি,
চুল পেকে যাচ্ছে, ত্বকে ভাঁজ পড়ছে,
মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়ালে চমকে উঠি, এ কি সেই আমি!
যে আমাকে আমি দীর্ঘ দিন ধরে চিনি, এ কি সেই!
এখন প্রায় প্রতিদিনই খবর শুনতে হয় এর হা−র্ট অসুখ, ওর কিডনি চলে
যাচ্ছে,
লিভার যায় যায়।
শুনি জরায়ুতে বিদঘুটে কিছু বড় হচ্ছে, স্তনে ক্যানসার,
শুনি প্রো−স্টটে কিছু একটা ধরা পড়েছে, কারও ফুসফুস নষ্ট, হঠাৎ হাত
পা অবশ।
কবছর আগেও শুনেছি বন্ধুদের বাবার বাবা চলে গেলেন,
মার মা।
এরপর কারও বাবা, কারও মা।
হাহাকার করতে করতে চমকে উঠে দেখেছি আমার পাশে যে মা ছিলেন,
আমার নিজের মা,
আমার দিকে সেই কতকাল স্বপ্ন-চোখে তাকিয়েছিলেন,
হাতটি ধরে ছিলেন, আমার ঠাণ্ডা হাতটি,
নেই।
এখন বন্ধুরাও কেউ কেউ চলে যাচ্ছে , তাকালে বড় ফাঁকা দেখি
চারদিক,
যে ছিল, কালও ছিল, হঠাৎ বলা নেই, কওয়া নেই, নেই।
এখন এর ওর মত আমারও শরীরে একের পর এক উপদ্রপ জমছে।
আমাদের যাবার সময় হচ্ছে, আমরা সবাই খুব বুড়ো হয়ে যাচ্ছি —
শুনছো তোমরা?
অসুখগুলো আমাদের ছেড়ে কোথাও যেতে যাইছে না, এত যে তাড়াতে
চাইছি, তারপরও
কি অসভ্যের মত আমাদের টানছে অন্ধকার খাদের দিকে, দেখছো!
এই যে এত বই পত্তর, বেশির ভাগের পাতা এখনো ওল্টানো হয়নি
নাম ঠিকানা লেখা হাজার টুকরো কাগজ, কী হবে এসবের!
এই যে বাড়িগাড়ি, টাকা পয়সা, এই যে হাজারটা স্বপ্ন জড়ো করা আছে,
কী হবে!
জীবন গুছিয়ে নিয়ে বসতে বসতেই শুনি জীবনের একেবারে কিনারে
দাঁড়িয়ে আছি,
একটি কেবল টোকা পড়লেই হল..
শুনছো, আমরা খুব ভয়ংকর রকম, খুব অশ্লীল রকম, খুব জঘন্য রকম
নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছি!
সামনে আমাদের আয়না ছাড়া আর কিছু থাকছে না,
ঝকঝকে একটি আয়না, আর নাস্তার টেবিলে লাল নীল বড়ি,
মেপে ভাত, মেপে তরকারি, মেপে নুন চিনি, একশ রকম নিষেধের
কাদায় প্রতিদিন গলা পর্যন্ত ডুবে থাকতে হচ্ছে।
আমরা সবাই এমন বুড়ো হয়ে যাচ্ছি, আমার ভয় করছে খুব,
ভয় করছে বুড়ো হচ্ছি বলে,
কোথাও কোনও অন্ধকারে যে অন্ধকার থেকে কোথাও আর ফিরব না
কোনওদিন,
যেতে ইচ্ছে করছে না,
আমার ভয় হচ্ছে, রাগ হচ্ছে, অভিমান হচ্ছে, মায়া হচ্ছে,
চোখ খুলতে খুলতেই দেখি জীবনের একেবারে কিনারে দাঁড়িয়ে আছি,
একটি কেবল টোকা পড়লেই হল..
এই এতটুকু এক চিমটি জীবনে আমার শখ মেটে না,
এই এতটুকু এক বিন্দু জীবনে আমার তৃষ্ণা মেটে না,
এই এতটুকু এক তিল জীবনে আমার স্বস্তি হয় না,
এই এতটুকু এক কণা জীবনে আমার কিচ্ছু হয় না..
একবিন্দু মা
অনেকে আমার মা হতে চেয়েছে,অনেকে বাবা
অনেকে মামা কাকা খালা ফুপু
অনেকে সেসব বন্ধু, যাদের হারিয়েছি।
চেষ্টা চরিত্তির করে অনেকে বাবা হয়েছে অনেকটাই
কষ্টে সৃষ্টে মামা কাকা খালা ফুপু।
অনেকে বন্ধু হয়েছে নিমেষেই, কায়ক্লেশে নয়।
মা হতে অনেকে চেষ্টা করেছিল, মা হতে সেই অনেকের পর আরও
অনেকে চেষ্টা করেছিল
সেই আরও অনেকের পর আরও অনেকে। দিনের পর দিন অকথ্য
পরিশ্রম
করেছিল মা হতে তবু কেউ মা হতে পারেনি
ছিটেফোটা মা কেউ হতে পারেনি
এক ফোঁটা মা কেউ হতে পারেনি।
এক বিন্দু মা হতে পারেনি।
কলকাতা
আমাকে শহর থেকে তাড়িয়ে তুমি ভালো আছো তো! ভুলে আছো তো!
কুয়োর ব্যাঙ
আমার কাছে এই জীবনের মানে কিন্তু আগাগোড়াই অর্থহীন,
যাপন করার প্রস্তুতি ঠিক নিতে নিতেই ফুরিয়ে যাবে যে-কোনোদিন।
গ্রহটির এই মানবজীবন ব্রহ্মাণ্ডের ইতি-হাসে
এক পলকের চমক ছাড়া আর কিছু নয়।
ওইপারেতে স্বর্গ নরক এ বিশ্বাসে
ধম্মে কম্মে মন দিচ্ছে কী হয় কী হয় সারাক্ষণই গুড়গুড়ে সংশয়—
তাদের কথা বাদই দিই, সত্য কথা পাড়ি
খাপ খুলে আজ বের করিই না শখের তরবারি!
মানুষ তার নিজের বোমায় ধ্বংস হবে আজ নয়তো কাল,
জগত টালমাটাল।
আর তাছাড়া কদিন বাদে সুয্যিমামা গ্যাস ফুরিয়ে মরতে গিয়ে
পৃথিবীকে পেটের ভেতর এক চুমুকে শুষে নিয়ে
দেখিয়ে দেবে খেলা
সাঙ্গ হবে মেলা
জানার পরও ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিঁড়ে কামড়ে তুচ্ছ কিছু বস্তু পাওয়ার লোভ,
ভীষণ রকম পরস্পরে হিংসেহিংসি ক্ষোভ।
মানুষের ক-ই যাবে দুর্ভোগ!
তাকত লাগে ভবিষ্যতের আশা ছুঁড়ে মহানন্দে করে যেতে মুহূর্তকে
ভোগ।
ভালোবাসতে শক্তি লাগে, হৃদয় লাগে সবকিছুকেই ভাগ করতে সমান
ভাগে,
কজন পারে আনতে রঙিন ইচ্ছেগুলো বাগে?
ভুলে যাই এক মিনিটের নেই ভরসা,
আমাদের স্যাঁতস্যাঁতে-সব-স্বপ্ন-পোষা কুয়োর ব্যাঙের দশা।
ধুচ্ছাই
সমুদ্দুরে ঠাঁই পেতে চাই।