বেঁচে থাকা
একটি কফিনের ভেতর যাপন করছি আমি জীবন
আমার সঙ্গে একশ তেলাপোকা
আর কিছু কেঁচো।
যাপন করছি জীবন, যেহেতু যাপন ছাড়া কোনও পরিত্রাণ নেই
যেহেতু তেলাপোকাদেরও যাপন করতে হবে, কেঁচোগুলোকেও
যেহেতু শ্বাস নিচিছ আমি, তেলাপোকা আর কেঁচো
যেহেতু শ্বাস ফেলছি, বেঁচে থাকছি।
বেঁচে থাকছি যেহেতু বেঁচে থাকছি।
একটি কফিনের ভেতর কিছু প্ৰাণী
পরষ্পরের দিকে বড় করুণ চোখে তাকিয়ে আছি
আমরা পরষ্পরকে খাচ্ছি পান করছি
এবং নিজেদের জিজ্ঞেস করছি, কী লাভ বেঁচে!
না আমি না তেলাপোকা না কেচো কেউ এর উত্তর জানি না।
যদি হত
এরকম যদি হত তুমি আছ কোথাও, কোথাও না কোথাও আছে, একদিন দেখা হবে,
একদিন চাঁদের আলোয় ভিজে ভিজে গালিস্প হবে অনেক, যে কথাটি বলা হয়নি, হবে
যে কোনও একদিন দেখা হবে, যে স্পর্শটি করা হয়নি, হবে।
আজ হতে পারে, পরশু, অথবা কুড়ি বছর পর, যে চুমুটি খাওয়া হয়নি, হবে
অথবা দেখা হবে না, কুড়ি কেটে যাচ্ছে, দু কুড়িও
তুমি আছ কোথাও, ভাবা যেত তুমি হাঁটছ বাগানে, গন্ধরাজের গন্ধ নিচ্ছ
গোলাপের গোড়ায় জল দিচ্ছ, কামিনীর গা থেকে আলগোছে সরিয়ে নিচ্ছ মাধবীলতা,
অথবা স্নান করছ, খোঁপা করছ, দু এক কলি গাইছ কিছু
অধবা শুয়ে আছে, দক্ষিণের জানালায় এক ঝাঁক হাওয়া নিয়ে বসেছে লাল-ঠোঁট পাখি,
অথবা ভাবছ আমাকে, পুরোনো চিঠিগুলো ছুঁয়ে দেখছ, ছবিগুলো
গা পোড়া রোদ্দুর আর কোথাকার কোন ঘন মেঘ চোখে বৃষ্টি ঝরাচ্ছে তোমার ..
অথবা ভাবা যেত আমি বলে কেউ কোনওদিন কোথাও ছিলাম তুমি ভুলে গেছ,
তবু ভাবা তো যেত।
শরতের গ্রাম
ফসল তোলা সারা,
গরু ভেড়ার শীতের সঞ্চয়ও জড়ো করা সারা,
মেশিনগুলো ঝিমোচ্ছে, নিঝুম সারা পাড়া
কৃষকের কোনও কাজ নেই টেলিভিশনের বোতাম টেপা ছাড়া
কমপিউটারের ইঁদুর হাতে নিয়ে বসে থাকা ভদ্র বেড়াল
কোথাও যেতে ইচ্ছে, ঝকঝকে গাড়ি দাঁড়ানো আঙিনায়
প্ৰায় উড়ে কাছে কিংবা দূরে
চিড়িয়াখানায়, যাদুঘরে, গানের নাচের উৎসবে চলে যায়।
শরতের আকাশে মেঘবালিকারা ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে নেমেছে,
পাতায় পাতায় লাল হলুদ রং, ঘাসের বিছানায় টপু টাপ ঝরছে
আপেলে লাল হয়ে আছে মাঠ,
ময়লা তোলা গাড়ির পেটে কয়েকশ আপেল ঢুকে যাবে আসছে বুধবার।
শরত ছাপিয়ে কৃষকের মনে হয় এই বুঝি শীত এল, এই বুঝি
বরফে ঢেকে গেল সমস্ত সবুজ, আকাশ আকাশ অন্ধকার হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাথায় আর
না বন্ধু না প্ৰতিবেশি, মোমের আলোয় একা বসে মাখনে ভাজা শুকর খেতে খেতে
ফুরোচ্ছে বোতল বোতল আঙুরের রস।
এত মান, এত যশ তবু এই স্বৰ্গকেও কৃষকের মনে হয় স্বৰ্গ নয়,
স্বৰ্গ অন্য কোথাও, অন্য কোনও সূর্যালোকের দেশে।
ওদিকে অন্য দেশে অন্য কৃষকেরা লাঙলে জমি চাষ করে খালি পায়ে খালি গায়ে রোদে পুড়ে
বাড়ি ফেরে, ক্ষিদে পেটে নুন-ভাত গিলে ছাড়পোকা ভরা চট পেতে শোয়
আকাশের তারার মত দুএকটি স্বপ্ন ঝিকমিক করে নাগালের অনেক দূরে।
ভোর হলে শীর্ণ গরুদেরর তাড়িয়ে নেয় ক্ষেতে,
হাতে হাতে বুনতে হয় ধান, হাতেই কাটতে হয়, বইতে হয়। কাঁধে, ঘামে ভেজা তামাটে কাঁধে,
সারাবছর শস্য ফিলিয়েও দুবেলা পায় না খেতে।
শিউলি বিছানো পথ
শিউলি বিছানো পথে প্ৰতিদিন সকালে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে তোমাকে
কি ভীষণ ভালবাসতে শিউলি তুমি।
একটি ফুলও এখন আর হাতে নিই না আমি, বড় দুৰ্গন্ধ ফুলে।
আমি হাঁটছি, হেঁটে যাচ্ছি, কিন্তু হেঁটে কোথাও পৌঁছোচ্ছি না।
কোথাও পৌঁছব বলে আমি আর পথ চলি না। কোনও গন্তব্য, আগে যেমন ছিল, নেই। অপ্ৰকৃতহের মত দক্ষিণে উত্তরে পুবে পশ্চিমে হাটি, হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে কোথাও ফিরি না। আমি।
এখন তো কোথাও কেউ আর আমার জন্য অপেক্ষা করে নেই।
এখন তো এমন কোনও কড়া নেই যে নাড়ব আর ভেতর থেকে তুমি খুলে দেবে দরজা।
এখন তো কেউ আমাকে বুকে টেনে নেবে না। সে আমি যেখান থেকেই ফিরি সুড়িখানা থেকে কী
বেশ্যাবাড়ি থেকে কী নর্দমা থেকে কী চুরি ডাকাতি করে কী মানুষ খুন করে।
শিউলি বিছানো পথে প্ৰতিদিন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে তোমাকে
কি ভীষণ ভালবাসতে তুমি শিউলি।
ফুলগুলো আমি পায়ে পিষে পিষে হাঁটি। তুমি ভালবাসতে এমন কিছু ফুটে আছে কোথাও দেখলে
বড় রাগ হয় আমার।
গোলাপ কী রজনীগন্ধা কী দোলনচাপা কী আমি।
এদের আমি দশানখে ছিঁড়ি,
দাঁতে কাটি, আগুনে পোড়াই। তুমিই যদি নেই, এদের আর থাকা কেন!
তুমি ছিলে বলেই না গোলাপে সুগন্ধ হত,
তুমি ছিলে বলেই এক একটি সুযোদয় থেকে কণা কণা স্বপ্ন বিচ্ছরিত হত,
তুমি ছিলে বলেই বৃষ্টির বিকেলগুলোয় প্রকৃতির আঙুলে সেতার এত চমৎকার বাজত।
তুমি নেই, বৃষ্টি আর পায়ে কোনও নুপুর পরে না,
স্নান সেরে রূপোলি চাদরে গা ঢেকে আকাশে চুল মেলে দিয়ে আগের মত চাঁদও আর গল্প শোনায় না।
তুমি নেই, কোনও গন্তব্যও নেই আমার। কোনও কড়া নেই, কোনও দরজা।
হেঁটে হেঁটে জীবন পার করি। কাঁধের ওপর বিশাল পাহাড়ের মত তোমার না থাকা।
গায়ে পেঁচিয়ে আছে তোমার না থাকার হা—মুখো অজগর।
পায়ের তলায় তোমার না থাকার সাহারা,
পুবে পশ্চিমে দক্ষিণে উত্তরে হাটছি। আমি, আমার সঙ্গে হাঁটছে বিকট তোমার না-থাকা।
যত হাঁটি দেখি পথগুলো তত শিউলি ছাওয়া
তুমি সে যে কি ভালবাসতে শিউলি
কি দরকার আর শিউলি ফুটে, যদি তুমিই নেই!
কি দরকার আর ফুলের সুগন্ধে, তুমিই যদি নেই!
কি দরকার আমার!