- বইয়ের নামঃ হাসু
- লেখকের নামঃ জসীম উদ্দীন
- প্রকাশনাঃ পলাশ প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আমার বাড়ি
আমার বাড়ি যাইও ভোমর,
বসতে দেব পিঁড়ে,
জলপান যে করতে দেব
শালি ধানের চিঁড়ে।
শালি ধানের চিঁড়ে দেব,
বিন্নি ধানের খই,
বাড়ির গাছের কবরী কলা,
গামছা-বাঁধা দই।
আম-কাঁঠালের বনের ধারে
শুয়ো আঁচল পাতি,
গাছের শাখা দুলিয়ে বাতাস
করব সারা রাতি।
চাঁদমুখে তোর চাঁদের চুমো
মাখিয়ে দেব সুখে
তারা ফুলের মালা গাঁথি,
জড়িয়ে দেব বুকে।
গাই দোহনের শব্দ শুনি
জেগো সকাল বেলা,
সারাটা দিন তোমায় লয়ে
করব আমি খেলা।
আমার বাড়ি ডালিম গাছে
ডালিম ফুলের হাসি,
কাজলা দীঘির কাজল জলে
কাঁসগুলি যায় ভাসি।
আমার বাড়ি যাইও ভোমর,
এই বরাবর পথ,
মৌরী ফুলের গন্ধ শুঁকে
থামিও তব রথ।
আলাপ
ঘুমপাড়ানী ঘুমের দেশে ঘুমিয়ে দুটি আঁখি,
মুখেতে তার কে দিয়েছে চাঁদের হাসি মাখি।
পা মেজেছে চাঁদের চুমোয়, হাতের ঘুঠোয় চাঁদ,
ঠোঁট দুটিতে হাসির নদীর ভাঙবে বুঝি বাঁধ।
মাথায় কালো চুলের লহর পড়ছে এসে মুখে,
ঝাঁকে ঝাঁকে ভোমর যেন উড়ছে ফুলের বুকে।
এই খুকীটির সঙ্গে আমার আলাপ যদি হয়,
সাগর-পারের ঝিনুক হয়ে ভাসব সাগরময় ;
রঙিন পাখির পালক হয়ে ঝরব বালুর চরে,
শঙ্খমোতির মালা হয়ে দুলব টেউএর পরে।
তবে আমি ছড়ার সুরে ছড়িয়ে যাব বায়,
তবে আমি মালা হয়ে জড়াব তার গায়।
এই খুকীটি আমায় যদি একটু আদর করে,
একটি ছোট কথা শোনায় ভালবাসায় ভরে ;
তবে আমি বেগুন গাছে টুনটুনীদের ঘরে,
যত নাচন ছড়িয়ে আছে আনব হরণ করে :
তবে আমি রুপকথারি রুপের নদী দিয়ে,
চলে যাব সাত-সাগরে রতন মানিক নিয়ে ;
তবে আমি আদর হয়ে জড়াব্ তার গায়,
নুপুর হয়ে ঝুমুর ঝুমুর বাজব দুটি পায়।
পলাতকা
হাসু বলে একটি খুকু আজ যে কোথা পালিয়ে গেছে-
না জানি কোন অজান দেশে কে তাহারে ভুলিয়ে নেছে।
বন হতে সে পলিয়ে গেছে, বনে কাঁদে বনের লতা,
ফুল ফুটে কয় সোনার খুকু! ছেড়ে গেলি মোদের কোথা?
বনের শাখা দুলিয়ে পাতা-করত বাতাস তাহার গায়ে।
তাহার শাড়ীর আঁচল লাগি ঝুমকো লতা দুলত বনে,
গাছে গাছে ফুল নাচিত তাহার পদধ্বনির সনে।
বনের পথে ডাকত পাখি, তাদের সুরের ভঙ্গী করে-
কচি মুখের মিষ্টি ডাকে সারাটি বন ফেলত ভরে।
প্রতিধ্বনি তাহার সনে করত খেলা পালিয়ে দূরে,
সুরে সুরে খুঁজত সে তার বনের পথে একলা ঘুরে।
সেই হাসু আজ পালিয়ে গেছে, পাখির ডাকের দোসর নাহি,
প্রতিধ্বনি আর ফেরে না তাহার সুরের নকল গাহি।
হাসু নামের একটি খুকু পালিয়ে গেছে অনেক দূরে,
কেউ জানে না কোথায় গেছে কোন্ বা দেশে কোন্ বা পুরে।
বাপ জানে না, মায় জানে না কোথায় সে যে পালিয়ে গেছে,
সেও জানে না, কোন সুদূরে কে তাহারে সঙ্গে নেছে।
কোনোখানে কেউ ভাবে না, কেউ কাঁদে না তাহার তরে,
কেউ চাহে না পথের পানে, কখন হাসু ফিরবে ঘরে।
মায় কাঁদে না, বাপ কাঁদে না, ভাই-বোনেরা কাঁদছে না তার,
খেলার সাথী কেউ জানে না, সে কখনও ফিরবে না আর।
ফিরবে না সে, ফিরবে নারে, খেলা ঘরের ছায়ার তলে,
মিলবে না সে আর আসিয়া তার বয়সের শিশুর দলে।
পেয়ারা-ডালে দোলনা খালি, ইঁদুরে তার কাটছে রশি,
চোড়ুই ভাতির হাঁড়ির পরে কাক দুটি আজ ডাকছে রশি,
খেলনাগুলি ধূলায় পড়ে, হাত-ভাঙা কার, পা ভাঙা কার,
ঝুমঝুমিটি বেহাত হয়ে বাজছে হাতে যাহার তাহার।
এসব খবর কেউ জানে না, সে জানে না, কেমন করে
কখন যে সে পালিয়ে গেলে তাহার চিরজনম তরে।
জানে তাহার পুতলগুলো অনাদরে ধুলায় লুটায়,
বুকে করে আর না চুমে, পুতুল-খেলার সেই ছোট মায়।
মাতৃ হারা মিনি-বিড়াল কেবা তাহার দুঃখ বুঝে,
কেঁদে কেঁদে বেড়ায় সে তার ছোট্ট মায়ের আঁচল খুঁজে।
খেলা ঘর আজ পড়ছে ভেঙে, শিশু কল-তানের সনে,
পুতুল বধূ আর সাজে না পুতুল-বরের বিয়ের কনে।
হাসু নামের সোনার খুকু আজ যে কোথা পালিয়ে গেছে,
সাত-সাগরের অপর পারে কে তাহারে ভুলিয়ে নেছে।
পালিয়ে গেছে সোনার হাসুঃ- খেলার সাথী আয়রে ভাই-
আজের মত শেষ খেলাটি এইখানেতে খেলে যাই।
সেখানটিতে খেলেছিলাম ভাঁড়-কাটি সঙ্গে নিয়ে,
সেইখানটি দে রুধে ভাই ময়না কাঁটা পুতে দিয়ে।
পালের নাও
পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও-
ঘরে আছে ছোট বোনটি তারে নিয়ে যাও !
কপিল-সারি গাইয়ের দুধ যেয়ো পান করে,
কৌটা ভরি সিঁদুর দেব কপালটি ভরে।
গুরার গায়ে ফুল চন্দন দেব ঘষে ঘষে,
মামা-বাড়ির বলব কথা-শুনো বসে বসে।
কে যাওরে পাল-ভরে কোন দেশে ঘর,
পাছা নায়ে বসে আছে কোন সওদাগর ?
কোন দেশে কোন গাঁয়ে হিরে ফুল ঝরে,
কোন দেশে হিরামন পাখি বাস করে।
কোন দেশে রাজ-কনে, খালি ঘুম যায়,
ঘুম যায় আর হাসে হিম-সিম বায়!
সেই দেশে যাব আমি কিছু নাহি চাই,
ছোট মোর বোনটিরে সাথে যাদি পাই।
পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও-
তোমার যে পালে নাচে ফুলঝুরি বাও-
তোমার যে নার ছই আবের ঢাকনি,
ঝলমল জ্বলিতেছে সোনার বাঁধুনি।
সোনার না’বাঁধনরে তার গোড়ে গোড়ে,
হিরামন পঙ্খির লাল পাখা ওড়ে।
তার পর ওড়েরে ঝালরের হাসি,
ঝলমল জলে জ্বলে রতনের রাশে।
এই নাও বেয়ে যায় কোন সওদাগর,
কয়ে যাও-কয়ে যাও, কোন দেশে ঘর ?
পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও-
ঘরে আছে ছোট বোন তারে নিয়ে যাও।
যে না গাঙে সাতধার করে গলাগলি,
সেথা বাস কুহেলির-লোকে গেছে বলি।
পারাপার দুই নদী-মাঝে বালচুর,
সেইখানে বাস করে চাঁদ-সওদাগর।
এপারে ভুতুমের বাসা ও-পারেতে টিয়া-
সে খানেতে যেয়োনারে নাওখানি নিয়া।
ভাইটাল গাঙ দোলে ভাটী গেঁয়ো সোঁতে,
হবে নারে নাও বাওয়া সেথা কোনমতে।