মুসলমানগণ বলিয়া থাকেন যে, প্রত্যেক মানুষের পাপ-পুণ্যের পরিচয়পূর্ণ একখানি পুস্তক লিখিত থাকে। পরীক্ষার দিনে সেই পুস্তক বিচারার্থীগণের হস্তে প্রদান করা হইবে। পুণ্যবান ব্যক্তিগণ ডান হস্তে সেই পুস্তক গ্রহণ করিয়া আনন্দের সহিত পাঠ করিবেন। পাপীগণের বাম হস্ত পিঠের সহিত এবং ডান হস্ত গলার সহিত বাঁধা থাকিবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাহাদের বাম হস্তে বলপূর্বক সেই পুস্তক দেওয়া হইবে।
বিচারক্ষেত্রে তুলাদণ্ড থাকিবে। যে পুস্তকে পাপ-পুণ্যের কথা লিখিত হইতেছে, সেই পুস্তক তুলাদণ্ডে পরিমাপ করা হইবে। যাহার পাপের ভাগ বেশি, সে দণ্ড ভোগ করিবে এবং যাহার পুণ্যের ভাগ বেশি, সে রক্ষা পাইবে। বিচারের পর পুণ্যবানগণ স্বর্গের দিকে দক্ষিণ পথে এবং পাপীগণ নরকের দিকে বাম পথে যাইবে।
পাপী-পুণ্যবান সকলকেই আল সিরাত নামক একটি সেতু পার হইতে হইবে। সেই সেতু চুলের অপেক্ষা সূক্ষ্ম এবং তরবারির অপেক্ষা তীক্ষ্ণ ধারসম্পন্ন। নিম্নে ভীষণ অগ্নিময় নরককুণ্ড এবং উপরে ক্ষুরধার সূক্ষ্ম সেতু বিরাজমান। পুণ্যবানগণ অনায়াসে নিমেষমধ্যে সেতু পার হইয়া স্বর্গে গমন করিবেন এবং পাপীগণ পার হইবার সময়ে নরকার্ণবে পতিত হইবে।
মুসলমানদের মতে, নরকের সাতটি ভাগ এবং স্বর্গের আটটি। সাতটি নরকের (দোজখের) নাম –জাহান্নাম, লাধা, হোতামা, আল-সৈর, সাকা, আল-জাহিম ও আল-হায়াইত (হাবিয়া)। ভিন্ন ভিন্ন ধরণের পাপীগণ ভিন্ন ভিন্ন নরকে নিক্ষিপ্ত হইবে। সর্বোচ্চ পাপীর জন্য নির্ধারিত সর্বনিম্নস্থ নরক হাবিয়া। নরকের প্রতি প্রকোষ্ঠে ঊনিশ জন করিয়া প্রহরী (ফেরেশতা) আছে, প্রধান প্রহরীর নাম মালেক।
আটটি স্বর্গের (বেহেশতের) নাম– লদ, দারুস সালাম, দারুল করার, উদন, আল মাওয়া, জান্নাতুল নঈম, জান্নাতুল ইলিন ও জান্নাতুল ফেরদাউস। স্বর্গের প্রধান প্রহরীর নাম। রেজওয়ান। স্বর্গের সর্বোচ্চ স্তরের উধৃভাগে আল্লাহর আসন অবস্থিত। উহারই নিম্নভাগে সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম স্বর্গ ফেরদাউস। সেখানে সুখের অন্ত নাই। মনোহর উদ্যান, উৎস, নদী প্রভৃতি সেখানে বিরাজমান। সেখানকার নদীর কোনোটিতে পরিশ্রুত জল, কোনোটিতে দুগ্ধ, কোনোটিতে মধু, কোনোটিতে সুগন্ধী নির্যাস বহিয়া যাইতেছে। সেখানকার প্রস্তরসমূহ মুক্তা, প্রবাল ও মরকতময়। সেখানকার অট্টালিকাসমূহ স্বর্ণে বা রৌপ্যে নির্মিত। সেখানকার বৃক্ষের কাণ্ডসমূহ সুবর্ণময়।
ঐ স্বর্গে তুবা নামক একটি বৃক্ষ আছে। ঐ বৃক্ষটি সর্বসুখের আধার। স্বর্গবাসী সকলের ভবনেই সেই বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত। যিনি যেই ফলের আশা করিবেন, ঐ বৃক্ষে তিনি সেই ফলই প্রাপ্ত হইবেন।
স্বর্গে আল-কাওসার নামে একটি নদী প্রবাহিত আছে, সেরূপ সুগন্ধ ও সুস্বাদু জলে পূর্ণ নদী দ্বিতীয়টি নাই। একবার তাহার জল পান করিলে আর কখনও তৃষ্ণা পায় না।
সকল সুখের সারভূত সেখানকার হুরীগণ। অপরূপ রূপ-লাবণ্য সম্পন্ন হুরীগণ স্বর্গবাসীদিগের মনোরঞ্জনের জন্য নিযুক্ত রহিয়াছে। তাহাদের সুবৃহৎ কৃষ্ণবর্ণ চক্ষু। তজ্জন্য তাহারা হুর-অল-ঐন নামে পরিচিত। মর্ত্যের রমণীগণ মৃত্তিকায় নির্মিত, কিন্তু সেই সুন্দরীবগণ মৃগনাভি দ্বারা গঠিত হইয়াছে।
.
# চৈনিক মত
কর্মানুসারে স্বর্গ-নরক লাভের এবং আত্মার অবিনশ্বরত্বের বিষয় চীনাগণও বিশ্বাস করেন। স্বর্গগত পিতৃ-পিতামহের উদ্দেশ্যে অভিবাদন চীন দেশে আবহমান কাল প্রচলিত আছে। পরলোক সম্বন্ধে চীন দেশে যে মত প্রচলিত আছে, অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার তাঁহার ‘প্রাচ্যদেশের পবিত্র গ্রন্থসমূহ’ নামক গ্রন্থের অংশবিশেষে উহার একটি পরিচয় প্রদান করিয়াছেন।
খ্রী. পূ. ১৪০১ হইতে ১৩৭৪ অব্দের মধ্যে চীন দেশে পান করং নামক একজন রাজা ছিলেন। তিনি আপনার প্রজাদিগকে যে উপদেশ দেন, উপরোক্ত গ্রন্থে ম্যাক্সমূলার তাহা প্রকাশ করিয়াছেন। রাজার উপদেশের মর্ম এই —
“হে প্রজাবর্গ! তোমাদিগের প্রতিপালন ও শ্রীবৃদ্ধি সাধনই আমার উদ্দেশ্য। আমার পূর্বপুরুষগণ এক্ষণে আধ্যাত্মরাজ্যের অধীশ্বর। এখন কেবল তাহাদের কথাই আমার স্মৃতিপটে উদিত হইতেছে। আমার রাজ্যশাসনে যদি কোনোরূপ ভ্ৰম-প্রমাদ, ঘটে, এবং আমি যদি অধিককাল মর্তলোকে বাস করি, আমার এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা সেই স্বর্গীয় নৃপতিগণ আমার দণ্ডবিধান করিবেন। আমি প্রজাদিগের প্রতি যদি কোনোরূপ অত্যাচার করি, তাহারা আমার দণ্ডবিধান করিয়া বলিবেন, “আমার প্রজাদিগের প্রতি কেন তুমি অত্যাচার করিয়াছ?” যেমন আমার সম্বন্ধে, তেমন তোমাদের সম্বন্ধে সেই স্বর্গীয় পিতৃপুরুষগণ দৃষ্টি রাখিয়াছেন। হে আমার অসংখ্য প্রজাপুঞ্জ! তোমরা যদি আমার সহিত একমত না হও, সকলে একমত হইয়া আমার মতের অনুসরণ না কর, তোমাদের জীবন চিরস্মরণীয় করিবার চেষ্টা না কর– আমার সেই স্বর্গীয় পিতৃপুরুষগণ তোমাদের সেই অপরাধের জন্য তোমাদের প্রতি কঠোর দণ্ডের বিধান করিবেন। তোমাদিগকেও আহ্বান করিয়া বলিবেন, কেন তোমরা আমাদের বংশধরের মতানুবর্তী হইতেছ না? জানিও, ইহাতে তোমাদের সকল পুণ্য ক্ষয়প্রাপ্ত হইবে। রোষপরবশ হইয়া পিতৃপুরুষগণ যখন তোমাদিগের দণ্ডবিধান করিবেন, তখন তোমরা কোনোমতে রক্ষা পাইবে না। তোমাদেরও পিতৃ-পিতামহ পূর্বপুরুষগণ তখন তোমাদিগকে পরিত্যাগ করিবেন। তাহারা মৃত্যুযন্ত্রণা হইতে কদাচ তোমাদিগকে রক্ষা করিবেন না।”