.
# খ্রীস্টানদের মত
খ্রস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের (নিউ টেস্টামেন্টের) ম্যাথু, লুক, রিভিলেশন, কোরিন্থিয়ানস ও রোমানস্ প্রভৃতি অংশে পুনরুত্থানের বিষয় বিশদভাবে বিবৃত হইয়াছে। তাহাতে প্রকাশ –আপন পাপকর্ম দ্বারাই মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। সকল মানুষই অধিক পাপে রত। সুতরাং সকলেই মৃত্যুর অধীন। মৃত্যুর পর আত্মা দেহ হইতে বিকারপ্রাপ্ত ও ধূলায় পরিণত হয়। মৃত ব্যক্তিদিগের মধ্যে যাহারা পুণ্যবান, দেহত্যাগের পরেই তাহাদের আত্মা স্বর্গে গমন করে। পাপীর আত্মা শেষ বিচারের দণ্ডের জন্য প্রস্তুত হয়। শেষে একদিন তাহাদের বিচার হইরে। সেই দিন পবিত্র আত্মা যীশু খ্রীস্ট স্বর্গ হইতে মর্ত্যে অবতরণ করিবেন। স্বর্গীয় বেশে সুসজ্জিত এবং স্বর্গীয় দূত ও প্রিয় পারিষদসমূহে পরিবৃত হইয়া সেইদিন তিনি বিচারাসনে উপবিষ্ট হইবেন। মৃত ব্যক্তিগণ সেইদিন কবর হইতে উত্থিত হইবে এবং বিচারপতি প্রভু (যীশু) তাহাদের বিচার করিবেন। পাপাত্মাগণের প্রতি দণ্ডাদেশ প্রদত্ত হইবে। স্বর্গীয় দূতগণ পাপীগণকে দণ্ডদানে প্রস্তুত হইবেন। পাপীদিগকে চিরপ্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হইবে, তাহারা যন্ত্রণায় ছটফট করিতে থাকিবে। সেই বিচারে অতি অল্প ব্যক্তিই পুণ্যবান বলিয়া নির্দিষ্ট হইবেন। পুণ্যবানদিগকে অত্যুজ্জ্বল আলোকমালায় শোভিত প্রাসাদে লইয়া যাওয়া হইবে। সেখানে তাহারা চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় আহারাদি প্রাপ্ত হইবেন এবং সর্বসুখে সুখী থাকিবেন। তাহাদের সেই আনন্দোৎসবে তাহাদের পূর্বপুরুষগণ, অবতারগণ এবং স্বয়ং যীশুখ্রীস্ট তাহাদের সহিত যোগদান করিবেন ইত্যাদি। এই মতে বিচারকর্তা স্বয়ং ঈশ্বর নহেন, যীশু।
আলোচ্য পুস্তকসমূহে প্রলয়ান্তে পুনরুত্থান সম্বন্ধে যে সকল বিষয় লিপিবদ্ধ আছে, তাহার মর্মমাত্র এই স্থলে প্রদত্ত হইল।
.
# মুসলমানদের মত
ইসলামীয় মতে, প্রলয়ের (কেয়ামতের) চল্লিশ বৎসর (মতান্তরে চল্লিশ দিন) পরে এস্রাফিল ফেরেশতা দ্বিতীয়বার শিঙ্গা বাজাইবেন এবং পুনঃ জগত সৃষ্ট হইবে, হয়তোবা নূতন রূপে। পুনঃ সৃষ্টির পর একদিন মৃতের পুনরুত্থান হইবে। সেই দিন সকলেই আপন আপন পাপ-পুণ্যের ফল ভোগ করিবেন।
কোনো মতে, বিচারের দিনে একমাত্র আত্মাই বিচারের জন্য উপস্থিত হইবে। কিন্তু সাধারণ বিশ্বাস এই যে, সেইদিন দেহ ও আত্মা পূর্বাকারপ্রাপ্ত হইয়া বিচারপতির নিকট উপনীত হইবে। কেননা বলা হইয়া থাকে যে, বিচারক্ষেত্রে (হাশর ময়দানে) পাপীগণের হস্ত, পদ, চক্ষু, কর্ণ ইত্যাদি পাপকর্মের সাক্ষ্য প্রদান করিবে। দোজখের শাস্তির বর্ণনায় বলা হইয়া থাকে যে, পাপীদিগকে পুঁজ-রক্ত ইত্যাদি খাইতে দেওয়া হইবে, অগ্নির উত্তাপে মস্তিষ্ক বিগলিত হইবে, যেই ব্যক্তি পরস্ত্রী দর্শন করিয়াছে, সঁড়াশীর সাহায্যে তাহার চক্ষু উৎপাটন করা হইবে এবং স্বর্গের সুখের বর্ণনায় বলা হইয়া থাকে যে, পুণ্যবানগণ নানাবিধ সুমিষ্ট ফল আহার করিবেন, নেশাহীন মদিরা পান করিবেন, হুরীসহবাস লাভ করিবেন ইত্যাদি। এই সমস্ত বর্ণনায় ও অন্যান্য ঘটনার বিবরণে পরজগতে দেহের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হইয়া থাকে।
যে দেহ ধূলায় মিশিয়া যায়, তাহার পুনরুত্থান কিরূপে সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা হইয়া থাকে যে, সকল শরীর বিলয়প্রাপ্ত হইলেও আল-আজব (মানুষের মেরুদণ্ডের নিম্নভাগের একখানা হাড়) কখনও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় না। উহ বীজম্বরূপ বিদ্যমান থাকে। পুনরুত্থানের সময়ে অন্যান্য অংশ আপনিই আসিয়া তাহার সহিত মিলিত হইবে। বিচারদিনের পূর্বে চল্লিশ দিন ব্যাপী ভীষণ বৃষ্টিপাত হইবে। সেই বৃষ্টির জলে মেরুদণ্ডের অস্থি সিক্ত হইয়া তাহা হইতে অঙ্কুরোদগমের ন্যায় নরদেহ উদগত হইবে। অতঃপর এসাফিল ফেরেশতা তৃতীয়বার শিঙ্গা ফুঁকিলে শিঙ্গায় রক্ষিত আত্মসমূহ মক্ষিকার ন্যায় ইতস্তত উড়িয়া গিয়া আপন আপন দেহে প্রবেশ করিবে ও মানুষ সজীব হইবে। সমস্ত মানবকুলের মধ্যে এইরূপ সর্বপ্রথম জীবন লাভ করিবেন হজরত মোহাম্মদ (সা.)।
পুনরুত্থানের সময় মনুষ্য, জ্বীন, ফেরেশতা ও অন্যান্য জীবজন্তু সকলেই পুনর্জীবিত হইবে এবং মানুষ ও জ্বীনগণের বিচার হইবে। কিন্তু ইতর জীবের বিচার হইবে কি না, সেই বিষয়ে মতভেদ আছে।
মনুষ্যদিগকে কোন্ রূপে বিচারপতির নিকট উপস্থিত করা হইবে, সেই বিষয়েও দ্বিমত দেখা যায়। এক মতে প্রকাশ, মাতৃগর্ভ হইতে যে অবস্থায় তাহারা ভূমিষ্ঠ হইয়াছিল (নগ্নদেহে), সেই অবস্থায় তাহারা বিচারপতির নিকট উপস্থিত হইবে। অন্য মতে, যে ব্যক্তি যেরূপ বস্ত্রাদি পরিধান করিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছিল (বিধর্মীদের পোষাকের অনুকরণ করিয়া থাকিলে), সেইরূপ বেশভূষাতেই সে পুনরুত্থিত হইয়া বিচারার্থ প্রস্তুত থাকিবে।
কথিত হয় যে, বিচারের দিনে নানা শ্রেণীর লোক নানা অবস্থায়, কেহ ঘোড়া বা উটে চড়িয়া, কেহ হাঁটিয়া, কেহবা মাটিতে মুখ ঘষিতে ঘষিতে বিচারপতির সম্মুখে উপস্থিত হইবে।
আল্লাহ্ কোথায় বসিয়া বিচার করিবেন, সেই বিষয়ে নানা মত দৃষ্ট হয়। কেহ কেহ বলেন যে, হজরত বলিয়া গিয়াছেন, “সিরিয়া প্রদেশে বিচারক্ষেত্র নির্দিষ্ট আছে।” কেহ বলেন, এক শ্বেত সমতল ক্ষেত্রে বিচার হইবে, সেখানে অট্টালিকা বা মনুষ্যাদির কোনো চিহ্ন নাই। অন্য মতে, সেই পৃথিবীর সহিত এই পৃথিবীর কোনো সম্বন্ধ নাই, সে এক নূতন পৃথিবী।