যে সমস্ত পাপী সেতু পার হইতে পারে না, তাহারা দুখ নামক দুঃখার্ণবে নিপতিত হইয়া নরকযন্ত্রণা ভোগ করে। তথায় দেবগণ (হিন্দুমতে দৈত্য) তাহাদিগকে অশেষ যন্ত্রণা প্রদান করেন। কোন্ পাপাচারী কতদিন দুঃখার্ণবে কিরূপভাবে যন্ত্রণা ভোগ করিবে, অহুর মজদা তাহা নির্দেশ করিয়া দেন। উপাসনা দ্বারা এবং বন্ধু-বান্ধবের মধ্যস্থতায় কাহারও কাহারও দুঃখভোগের কাল হ্রাসপ্রাপ্ত হইয়া থাকে।
ইরানীয়দের মতে, সৃষ্টির অবসানে পৃথিবী ধ্বংসপ্রাপ্ত হইলে সওসন্ত নামক একজন অবতারের আবির্ভাব হইবে। তিনি অত্যাচার-অবিচার হইতে পৃথিবীকে মুক্ত করিবেন। তখন সেই নূতন। পৃথিবীতে অনন্ত সুখের রাজ্য সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হইবে। ইহার পর বিশ্বব্যাপী পুনরুত্থানে বন্ধু-বান্ধব। এবং আত্মীয়-স্বজন পুনরায় মিলিত হইতে পারিবে। সেই আনন্দের সম্মিলন সংঘটিত হইলে সৎ ও অসতের মধ্যে পার্থক্য ঘটিবে। যাহারা অধর্মচারী, তাহারা ভীষণ যন্ত্রণা ভোগ করিবে ইত্যাদি।
.
# ইহুদিদের মত
ইহুদিদিগের জুডাইজম ধর্মমতে মৃত্যুর পর বিচারের একটি শেষদিন নির্দিষ্ট আছে। সেই দিন মৃত ব্যক্তিগণের বা তাহাদের আত্মার পুনর্যুত্থান ঘটিবে। সেই দিন পাপ-পুণ্যের বিচার হইবে। কে পাপী, কে পুণ্যবান –নির্দিষ্ট একটি সেতু পার হইবার সময়েই তাহা স্থির হইয়া যাইবে (ইরানীয় মত গৃহীত)। ইহুদিগণের ধর্মগ্রন্থে পরীক্ষার দিনের বিষয়টি যেমন আছে, তেমন আছে তুলাদণ্ডে পাপ-পুণ্যের বিচারের কথা, মেশিয়া অর্থাৎ অবতারের আবির্ভাবের কথা এবং পরিশেষে চিরশান্তি প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গও। ইহুদিগণের ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্টে প্রকাশ –“সূত্রবৎ সূক্ষ্ম সেতুর উপর। দিয়া মনুষ্যকে শেষদিনে গমন করিতে হইবে। নিম্নে ভীষণ নরক, পাপাত্মাগণ সেই সেতু হইতে নরকার্ণবে নিপতিত হইবে।” তাহাদের ধর্মগ্রন্থমতে, মানুষের পাপ-পুণ্য দুইখানি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ থাকে। শেষ বিচারের দিনে সেই দুইখানি গ্রন্থ তুলাদণ্ডের দুই দিকে রাখিয়া প্রতি জনের পাপ ও পুণ্যের পরিমাপ করা হইবে। সেই পরিমাপে পাপের ভার গুরু হইলে, পাপাত্মা নরকযন্ত্রণা ভোগ করিবে; আর পুণ্যের ভাগ বেশি হইলে, পুণ্যাত্মা স্বর্গ লাভ করিবে।
ইহুদিদিগের স্বর্গের নাম ইডেন। ঐ স্বর্গ বহুমূল্য প্রস্তরে গঠিত। স্বর্গের তিনটি দ্বার। সেখানে চারিটি নদী প্রবহমানা– তাহার একটিতে দুগ্ধ, একটিতে মধু, একটিতে মদ্য এবং একটিতে সুগন্ধি নির্যাস।
স্বৰ্গকে ইহুদিগণ অতি উৎকৃষ্ট উদ্যানরূপে বর্ণনা করিয়া থাকেন। সেই উদ্যান বহু সুমিষ্ট ফলে এবং সুগন্ধ-সুদৃশ্য ফুলে পরিপূর্ণ। সেই উদ্যান হইতে পুণ্যবানগণ ক্রমশ উচ্চ হইতে উচ্চতর স্থানের অধিকার লাভ করেন (ইহা বৈদিক সপ্তস্বর্গের অনুকরণ)।
ইহুদিদিগের ধর্মগ্রন্থ ইশিয়া, এজিকিল, ডেনিয়েল ও যব প্রভৃতিতে পুনরুত্থানের বিষয় বর্ণিত আছে। ঐ সকল গ্রন্থের কোনো কোনো স্থলে লিখিত আছে, শুষ্ক অস্থিখণ্ড পুনর্জীবিত হইয়া আপন কর্মাকর্মের ফল ভোগ করিবে; কোনো কোনো স্থানে দেখা যায়, যাহারা পৃথিবীর অভ্যন্তরে ধূলিরাশির মধ্যে নিদ্রিত হইয়া আছে, তাহারা জাগরিত হইবে। যব গ্রন্থে প্রকাশ, যেমন শরীর ছিল, সেই শরীরেই অভ্যুত্থান ঘটিবে। ইহুদিগণ বলেন, নরদেহ কবরিত হইলে, দেহের অন্যান্য অংশ ধূলায় পরিণত হয় বটে, কিন্তু লুজ নামক অস্থি বরাবর অবিকৃত থাকে। বিচারের পূর্বে পুনরুত্থানের সময়ে পৃথিবীতে ভয়ানক শিশিরপাত হইবে। সেই নীহারে সিক্ত হইয়া পূর্বোক্ত অস্থি অঙ্কুরিত অর্থাৎ নরদেহপ্রাপ্ত হইবে।
সুধী পাঠকবৃন্দের স্মরণ থাকিতে পারে যে, পবিত্র বাইবেলের আদিমানব আদমকে সৃষ্টি করিয়া তাহার বসবাসের জন্য ইডেন নামক স্বর্গে ঈশ্বর স্থান দিয়াছিলেন। ঐ স্বর্গটি কোথায় অবস্থিত, তাহার বিশেষ বিবরণ আছে তৌরিত গ্রন্থে। বিবরণটি এইরূপ — “আর সদাপ্রভু ঈশ্বর পূর্বদিকে এদনে (ইডেনে) এক উদ্যান প্রস্তুত করিলেন এবং সেই স্থানে আপনার নির্মিত ঐ মনুষ্যকে রাখিলেন। আর সদাপ্রভু ঈশ্বর ভূমি হইতে সর্বজাতীয় সুদৃশ্য ও সুখাদ্যদায়ক বৃক্ষ এবং সেই উদ্যানের মধ্যস্থানে জীবনবৃক্ষ ও সদসদজ্ঞানদায়ক বৃক্ষ উৎপন্ন করিলেন। আর উদ্যানে জল সেচনার্থে এদন হইতে এক নদী নির্গত হইল। উহা তথা হইতে বিভিন্ন হইয়া চতুর্মুখ হইল। প্রথম নদীর নাম পীশোন, ইহা সমস্ত হবিলাদেশ বেষ্টন করে। তথায় স্বর্ণ পাওয়া যায় আর সেই দেশের স্বর্ণ উত্তম; এবং সেই স্থানে গুগগুলু ও গোমেদক মণি জন্মে। দ্বিতীয় নদীর নাম গীহোন, ইহা সমস্ত কুশদেশ বেষ্টন করে। তৃতীয় নদীর নাম হিদ্দেকল, ইহা অনূরিয়া দেশের মধ্য দিয়া প্রবাহিত। চতুর্থ নদী ফরাৎ। (আদিপুস্তক ২; ৮–১৪)
উক্ত বিবরণে দেখা যায় যে, পীশোন, গীহোন, হিকেল ও ফরাং এই নদী চারিটির উৎপত্তির এলাকার মধ্যে ঐ সময় ইডেন নামে একটি জায়গা ছিল। ইডেন জায়গাটি বোধ হয় বর্তমান তুরস্ক দেশের পূর্বভাগে পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। তৌরিতে লিখিত নদী চারিটি ঐ অঞ্চল হইতেই উৎপন্ন হইয়া, পীশোন ও গীহোন নামক নদীদ্বয় কৃষ্ণসাগর ও কাস্পিয়ান সাগরে এবং হিদেকল ও ফরাৎ নামক নদীদ্বয় একত্র হইয়া পারস্য উপসাগরে পতিত হইয়াছে। ঐ ইডেন উদ্যানে বাস করাকেই বলা হয় আদমের স্বর্গবাস। আবার প্রলয়ান্তে বিচারের পর যে স্বর্গের বিবরণ পাওয়া যায় এবং তাহাতে যে দুধ, মধু, মদ ও সুগন্ধি নির্যাসে পূর্ণ নদীচতুষ্টয়ের উল্লেখ দেখা যায়, বোধ হয় যে, তাহা পূর্বোক্ত স্বৰ্গই।