হিন্দুদের কোনো কোনো শাস্ত্রে পাপ ও পুণ্যকে তুলাদণ্ডে পরিমাপ করার বিষয় বর্ণিত আছে। মহাভারতের অনুশাসন পর্বের পঞ্চসপ্ততিতম অধ্যায়ে মহর্ষি ভীষ্ম বলিতেছেন, “সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞ এবং একমাত্র সত্য তুলাদণ্ডে পরিমাপ করা হইয়াছিল, কিন্তু সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞ হইতে সত্যই ভারি হইল।”
বৈদিক মতে এতক্ষণ যে সমস্ত বিষয় আলোচনা করা হইল, তাহাতে ইহাই বুঝা যায় যে, প্রলয়ান্তে পুনর্জীবন লাভ, পাপ-পুণ্যের বিচার, স্বর্গ ও নরক নামক পারলৌকিক রাজ্য, স্বর্গ-নরকের শ্রেণীবিভাগ ও সংখ্যা, শাস্তি বা পুরস্কারের বর্ণনা, স্বর্গপথে নদী পার হওয়া ইত্যাদি বিষয়সমূহ বৈদিক ও পৌরাণিক ঋষি মুনিগণ প্রচার করিয়াছিলেন।
.
# মিশরীয় মত
ভারতীয়, মিশরীয় ও ইরানীয় স্বর্গ-নরকের বর্ণনা একরূপ নহে। উহা ভিন্ন ভিন্ন দেশের মানুষের ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ ও রুচির পরিচায়ক। ভারতীয় স্বর্গের বর্ণনায় পাওয়া যায় নন্দন কানন, পারিজাত বৃক্ষ, সুরভী গাভী, ঐবারত হস্তী, উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব ও অপ্সরা-কিন্নরী ইত্যাদি; এবং মিশরীয় স্বর্গে নাকি কৃষিকাজের ব্যবস্থাও থাকিবে।
বহুযুগ ধরিয়া প্রাচীন মিশরীয়রা প্যাপিরাস বা সমাধিগাত্রে মৃতের জীবন বিষয়ে যে সকল কথা লিখিয়া গিয়াছেন, তাহারই সঙ্কলন আমদুয়াত গ্রন্থ, ফটকের গ্রন্থ ও মৃতের গ্রন্থ। মৃতের গ্রন্থের মতে, প্রত্যেক মৃতকে পরমেশ্বরের কাছে একটি সত্যপাঠ (Affidavit) দিতে হয়। সত্যপাঠটি এইরূপ — “হে পরম ঈশ্বর, সত্যের ও ন্যায়ের প্রভু! তোমাকে প্রণাম। হে প্রভু! আমি তোমায় কাছে সত্যকে বহন করিয়া আসিয়াছি। আমি কোনো ব্যক্তির প্রতি অবিচার, দরিদ্রের উপর অত্যাচার, কর্তব্যকর্মে ত্রুটি ও দেবতার অনভিপ্রেত কোনো কাজ করি নাই এবং স্বাধীন মানুষকে তাহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলপূর্বক কোনো কাজ করাই নাই … আমি পবিত্র, আমি পবিত্র।” এই সত্যপাঠটিতে প্রাচীন মিশরে প্রজার উপর রাজার, দরিদ্রের উপর ধনীর এবং গোলামের উপর মনিবের অবিচার, অত্যাচার ও জুলুমের ইঙ্গিত পাওয়া যায় (সেকালে বহু দেশেই দাসপ্রথা ছিল, কিন্তু মিশরের দাসেরা ছিল অতি উৎপীড়িত)।
ঐ সত্যপাঠ সত্য, কি মিথ্যা, তাহা যাচাই করেন জ্ঞানের দেবতা থৎ এবং হোরাস। মৃতের হৃৎপিণ্ড দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা হয়, একটি পাল্লায় ন্যায়ের প্রতীককে রাখিয়া। অতঃপর ন্যায় ও অন্যায়ের পরিমাণানুসারে মৃতকে শান্তি বা শাস্তি দেওয়া হয় (পাপ-পুণ্য পরিমাপের জন্য দাঁড়িপাল্লার ব্যবহারের বিবরণ হিন্দুশাস্ত্রেও আছে। তবে ইহা বলা যায় না যে, এই মতটির প্রথম প্রচারক আর্য ঋষিরা, না মিশরীয়রা)।
মৃতের গ্রন্থে শাস্তি বা পুরস্কারের বর্ণনা বেশি নাই। শাস্তির বিষয়ে এই মাত্র বলা হইয়াছে যে, দুষ্কৃতকারীকে কোনো ভক্ষকের কাছে দেওয়া হয়, তাহাকে ধ্বংস করার জন্য।
ফটকের গ্রন্থে বিচারদিন সম্পর্কে বর্ণনা এইরূপ — পরলোকে নানা ফটকের মধ্য দিয়া বিচার কামরায় ঢুকিতে হয়। এই বিচার কামরার সংলগ্ন দুইটি দ্বার দিয়া স্বর্গ ও নরককুণ্ডে প্রবেশ করা যায়। পুণ্যাত্মাগণ আলু নামক স্বর্গধামে যাইয়া মনের আনন্দে শস্যক্ষেত্র চাষ করে, আর পাপাত্মাদের নরককুণ্ডে পাঠাইয়া খুঁটির সঙ্গে বাধিয়া রাখা হয় –জ্বলন্ত আগুনে অথবা গভীর সমুদ্রে তাহাদের নিক্ষেপ করা হইবে বলিয়া (ইহা মিশরীয় গোলামের প্রতি মনিবের নির্মম অত্যাচারের প্রতীক)।
মৃতের গ্রন্থখানা বুক অব দি ডেড নামে ইংরাজিতে অনুদিত হইয়াছে। সেই গ্রন্থের সপ্তদশ, একবিংশ ও ষড়বিংশ অধ্যায়ত্ৰয়ে মৃত ব্যক্তির স্বর্গাদিলাভ সম্বন্ধে যাহা লিখিত আছে, তাহার কিয়দংশের মর্ম এইরূপ — মৃত্যুর পর পবিত্র আত্মা ঈশ্বরের অনুচরবর্গকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন, “হে ঈশ্বরের পারিষদগণ! তোমাদের বাহু প্রসারিত করিয়া আমাকে গ্রহণ কর, আমি যেন তোমাদের মধ্যে স্থান লাভ করি। হে জ্যোতিঃস্বরূপ ওসিরিস! সম্পূর্ণ অন্ধকারের মধ্যে আপনার প্রতাপ অক্ষুণ্ণ। আমি করজোড়ে আপনার শরণাপন্ন হইয়াছি। আপনার পবিত্র আত্মায় আমাকে আশ্রয় দান করুন। আমায় স্বর্গদ্বার উন্মুক্ত করিয়া দিন। মামফিসে আমার প্রতি যেরূপ আদেশ হইয়াছিল, আমি সেই আদেশ প্রতিপালন করিয়াছি। আমার হৃদয়ে এখন জ্ঞানসঞ্চার হইয়াছে …।” ঐ গ্রন্থের চতুর্দশ অধ্যায়ে লিখিত আছে, “এই মৃত ব্যক্তি নিম্নতম স্বর্গে দেবগণের অন্তর্ভুক্ত হইবেন। দেবগণ কখনোই ইহাকে পরিত্যাগ করিবেন না। কারণ ইহার আত্মা মুক্তির পথে অগ্রসর হইয়াছে। নরককীটে ইঁহাকে আর ভক্ষণ করিবে না।”
উপরোক্ত উদ্ধৃত অংশ পাঠ করিলে মিশরীয় স্বর্গ-নরকের স্বরূপ বুঝা যায়। অধিকন্তু উহাতে উচ্চ-নীচ স্বর্গের আভাস পাওয়া যায়। মিশরীয়গণ বিশ্বাস করিতেন যে, যুগ বিবর্তনান্তে তিন সহস্র বৎসর হইতে দশ সহস্র বৎসর পরে মৃত ব্যক্তির আত্মা দেশে ফিরিয়া আসিবে। এই বিশ্বাসের ফলেই মিশরে মৃতদেহ রক্ষার প্রথা প্রবর্তিত হয়।
.
# ইরানীয় মত
মৃত্যুর পর দণ্ড ও পুরস্কার আছে– ইরানীয়গণ ইহা বিশ্বাস করেন। মৃত্যুর পর মানুষ কি অবস্থা প্রাপ্ত হয়, তৎসম্বন্ধে জেন্দ-আভেস্তার ভেন্দিদাদ অংশে ও বুন্দেহেশ গ্রন্থে এইরূপ বর্ণনা আছে, “মৃত্যুর পর মানবদেহ দানবে অধিকার করে। তখন আত্মা অজ্ঞানান্ধকারে সমাচ্ছন্ন থাকে। তৃতীয় দিবসে আত্মার জ্ঞানসঞ্চার হয়। সেই রাত্রে আত্মাকে ভীষণ চিনাভাদ নামক পুল পার হইতে হয়। যে ব্যক্তি জীবিতকালে পাপকর্ম করিয়াছে, সেতু পার হইবার সময় সে নরকার্ণবে নিপতিত হয়, আর যে ব্যক্তি চিরজীবন ধর্মানুষ্ঠানে ও সৎকাজে অতিবাহিত করিয়াছেন, সে ব্যক্তি অনায়াসে সেতু উত্তীর্ণ হইতে পারেন। যাজঙ্গণ (এক শ্রেণীর স্বর্গদূত) সৎকর্মকারীগণকে সঙ্গে করিয়া চিরশান্তিময় স্থানে (স্বর্গে) লইয়া যান। সেখানে তাহারা অহুর মজদার সহিত মিলিত হন ও স্বর্ণসিংহাসনে সমাসীন হইয়া হুরান-ই বেহিস্ত নাম্নী পরীগণের সহবাসে সর্বপ্রকার আনন্দ উপভোগ করিতে থাকেন।” জেন্দ-আভেস্তায় স্বর্গ-নরকের শ্রেণীবিভাগ নাই। ইরানীয়দের স্বর্গের নাম গারো-ডে মান। পারস্যভাষায় উহা গাবাৎ মান নামে অভিহিত।