ঐ বেদের নবম মণ্ডলের ত্রয়োদশাধিক শততম সূক্তের সপ্তম ঋকে কশ্যপ ঋষি সোম দেবতার কাছে প্রার্থনা জানাইতেছেন, “যে ভুবনে সর্বদা আলোক, যে স্থানে স্বর্গলোক সংস্থাপিত আছে– হে ক্ষরণশীল! সেই অমৃত অক্ষয় ধামে আমাকে লইয়া চল।” ঋষি এইখানে এমন একটি স্থানের কামনা করিতেছেন, যেখানে দিবা আছে, রাত্রি নাই; জীবন আছে, মৃত্যু নাই এবং স্থানটির কখনও লয় নাই।
ঐ বেদের পঞ্চম মণ্ডলের পঞ্চষষ্ঠিতম সূক্তের চতুর্থ ঋকে উক্ত হইয়াছে, “মিত্র দেবতা স্তবকারীকে স্বর্গের পথ প্রদর্শন করেন।” এইখানে ঋষি মনে করিতেছেন যে, মিত্র দেব বা ভগবান তোষামোদপ্রিয়। মানুষের স্তব-স্তুতি বা প্রশংসায় তিনি তুষ্ট হন এবং স্তবকারীকে স্বর্গের পথ দেখাইয়া দেন।
ঐ মণ্ডলের ষষ্ঠষষ্ঠিতম সূক্তের ষষ্ঠ ঋকে মিত্র ও বরুণ দেবতার আহ্বানে রাত হব্য ঋষি প্রার্থনা করিতেছেন, “তোমাদিগের অনুগ্রহে আমরা যেন স্বর্গধাম প্রাপ্ত হই।” এই ঋকে ঋষি মনে করিতেছেন যে, শুধু স্তব-স্তুতি, হোম-যজ্ঞ অর্থাৎ পুণ্যবলেই স্বর্গ লাভ করা যাইবে না, চাই। দেবতার দয়া।
ঐ বেদের নবম মণ্ডলের ত্রয়োদশশতাধিক শততম সূক্তের অষ্টম ঋকে বলা হইয়াছে, “সেই যে তৃতীয় নাগলোক, তৃতীয় দিব্যলোক, যাহা নভোমণ্ডলের উর্ধে আছে, যথায় ইচ্ছানুসারে বিচরণ করা যায়, যে স্থান সর্বদাই আলোকময় –তথায় আমাকে অমর কর।” ঋষি এইখানে মনে করিতেছেন যে, স্বর্গরাজ্যটি আকাশমণ্ডলের ঊর্ধ্বভাগে অবস্থিত, সেখানে অবাধে চলাফেরা করা যায়, কোনো বাধার সম্মুখীন হইতে হয় না, ঐখানে দিন-রাত্রির বালাই নাই, উহা স্বতঃস্ফুর্ত আলোকে শোভিত। তাঁহার ঐখানে বাস করা যেন স্থায়ী হয়।
ঐ মণ্ডলের নবম ঋকে ঋষি প্রার্থনা করিতেছেন, “যথায় সকল কামনা নিঃশেষে পূর্ণ হয়, যথায় প্রধু নামক দেবতার ধাম আছে, যথায় যথেষ্ট আহার ও তৃপ্তিলাভ হয়– তথায় আমাকে অমর কর।” ঋষি এই ঋকে স্বর্গকে এইরূপ একটি দেশ কল্পনা করিতেছেন যে, সেখানে নৈরাশ্যের কোনো স্থান নাই এবং তৃপ্তিদায়ক প্রচুর খাদ্য পাওয়া যায়। ঋষি আশা করেন সেখানে অমর হইয়া থাকিতে।
ঐ মণ্ডলের দশম ঋকে ঋষি বলিতেছেন, “যথায় বিবিধ প্রকার আমোদ, আাদ, আনন্দ বিরাজ করিতেছে, যেখানে অভিলাষী ব্যক্তির তাবৎ কামনা পূর্ণ হয়, তথায় আমাকে অমর কর।” এই ঋকে ঋষি কল্পনা করিতেছেন যে, স্বর্গে নানাবিধ আমোদ-প্রমোদ, যথা– নাচ, গান, বাজনা ইত্যাদিও আছে এবং সেখানে নৈরাশ্যের স্থান নাই।
ঐ বেদের দশম মণ্ডলের ষোড়শ সূক্তের দ্বিতীয় ঋকে লিখিত আছে –মৃত ব্যক্তির অগ্নিসৎকার শেষ হইয়াছে; তাহার পর তাহার সম্বন্ধে বলা হইতেছে, “যখন ইনি সজীবত্বপ্রাপ্ত হইবেন, তখন দেবতাদিগের বশতাপন্ন হইবেন।” এই ঋকে বলা হইতেছে যে, মানুষ মৃত্যুর পর পুনঃ জীবিত হইবে এবং দেবগণের অধীন হইবে।
ঐ সূক্তের তৃতীয় ঋকে অগ্নি দেবতার আরাধনায় দমন ঋষি প্রার্থনা করিতেছেন, “হে জাতবেদা ও বহ্নি! তোমার যে মঙ্গলময়ী মূর্তি আছে, তাহাদিগের দ্বারা এই মৃত ব্যক্তিদিগকে পুণ্যবান লোকদিগের ভবনে বহন করিয়া লইয়া যাও।” ঋষি এইখানে চিতার আগুনকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন, মৃত ব্যক্তিগণকে পুণ্যবান লোকদের ভবনে অর্থাৎ স্বর্গে লইয়া যাইতে। মনে করা হয় যে, স্বৰ্গদেশটি উদ্ধৃদিকে অর্থাৎ আকাশে অবস্থিত এবং চিতার আগুনও ঐ দিকেই যায়। সুতরাং মৃত ব্যক্তিগণকে ঐখানে পৌঁছানো অগ্নির পক্ষে অসম্ভব নহে। কিন্তু অগ্নিদেবতা পৌঁছান একই জায়গায় –পাপী ও পুণ্যবানকে।
ঐ মণ্ডলের ষষ্ঠপঞ্চাশত সূক্তের তৃতীয় ও চতুর্থ ঋকে লিখিত আছে –“যেরূপ উত্তম স্তব করিয়াছিলে, তদ্রূপ উত্তম স্বর্গে যাও।” এই ঋকে দেখা যায় যে, পুণ্যের তারতম্যের জন্য উত্তম ও অধম, ভিন্ন ভিন্ন স্বর্গ আছে।
স্বর্গ ও নরক সম্বন্ধে বৈদিক শিক্ষার কিছু আলোচনা করা হইল। ইহা ভিন্ন হিন্দুশাস্ত্রে আরও অনেক মত দৃষ্ট হয়। তন্মধ্যে এইখানে আমরা আর একটি মতের পরিচয় প্রদান করিব। এই মতে জগত তিনটি। যথা –স্বর্গ, মর্ত ও পাতাল। অর্থাৎ উর্ধলোক, মধ্যলোক ও অধোলোক। আমাদের এই পৃথিবীটিই মধ্যলোক বা মর্তলোক। এইখান হইতে উর্ধদিকে উধূলোক বা স্বর্গ। উহা সাত ভাগে বিভক্ত। যথা –ভূলোক, ভূবলোক, স্বলোক, মহর্লোক, জনলোক, তপোলোক ও সত্যলোক। ইহাকে সপ্তস্বর্গ বলা হয়। মর্তলোকের নিম্নদিকে অধোলোক বা পাতাল। ইহাও সাত। ভাগে বিভক্ত। যথা –অতল, বিতল, সুতল, রসাতল, তলাতল, মহাতল ও পাতাল। ইহাকে বলা হয় সপ্তনরক। এই সপ্তনরকের অন্য নামও আছে। যথা –অম্বরীষ, রৌরব, মহারৌরব, কালসূত্র, তামিশ্র, অন্ধতামিশ্র ও অবীচি। মানুষ পুণ্যের তারতম্যানুসারে ক্রমান্বয়ে উর্ধ হইতে উর্ধতন স্বর্গের অধিকারী হয় এবং পাপের তারতম্যানুসারে নিম্ন হইতে নিম্নতম নরকে নিপতিত হয়, ইহাই এই মতের সিদ্ধান্ত। এই মতে, ত্রিজগত লয় হইবে না, লয় হইবে শুধু জীবকুল। তবে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড লয় ও পুনঃ সৃষ্টি হইবার মতও আছে।
হিন্দুশাস্ত্রে উক্ত আছে যে, স্বর্গরাজ্যে যাইবার পথে বৈতরণী নামক একটি নদী পার হইতে হয়। ঐ নদীর জল অগ্নিবৎ গরম, রক্ত-মাংস ও হাড়গোড়ে পরিপূর্ণ, দুর্গন্ধময় এবং কুমিরে ভরা। ঐ নদী নিরাপদে পার হইবার আশায় হিন্দুগণ মৃত্যুর পূর্বে বা পরে গো-দান করিয়া থাকেন।