জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, নক্ষত্রের বয়সের তারতম্যানুসারে উহাদের বর্ণের তারতম্য হইয়া থাকে। যে সকল নক্ষত্রের বর্ণ অতি নীল বা নীল, তাহাদের এখন পূর্ণ যৌবন এবং বয়সবৃদ্ধির সাথে সাথে বর্ণের পরিবর্তন হইয়া যথাক্রমে নীলাভ শাদা, শাদা, হলুদ ও নারাঙ্গি বর্ণ ধারণ করিয়া বার্ধক্যে হয় লাল। আকাশের লাল রঙের তারাগুলি এখন মরণপথের যাত্রী। এই লাল তারার দল আরও ঠাণ্ডা হইলে ছড়াইয়া দিবার মতো আলোর সম্বল তাহাদের ভাণ্ডারে থাকে না, তখন তাহারা আকাশে অদৃশ্য হইয়া যায়। ইহাই নক্ষত্রের মৃত্যু। এইরূপ মৃত নক্ষত্র আকাশে অনেক আছে।
কোনো কোনো বিজ্ঞানীর মতে –মহাকাশে কোনো কোনো সময় একটি মৃত নক্ষত্রের সঙ্গে আর একটি মৃত নক্ষত্রের সংঘর্ষ হয়। কেননা উহাদের আলো তাপ না থাকিলেও গতি থাকে। সংঘর্ষে উভয় নক্ষত্রের দেহ চুর্ণ-বিচুর্ণ হইয়া বাপে পরিণত হয় ও আগুন জ্বলিয়া উঠে। ফলে জন্ম হয় একটি নূতন নক্ষত্রের। নক্ষত্রদ্বয়ের দেহের আংশিক সংঘর্ষের ফলে যে আগুন জ্বলিয়া উঠে, তাহা কয়েক দিন, কয়েক মাস বা কয়েক বৎসরেই নিভিয়া যায়। কিন্তু সম্পূর্ণ গায়ে পড়া সংঘর্ষের ফলে যে আগুন জ্বলে, অর্থাৎ নক্ষত্রের জন্ম হয়, তাহা আকাশে টিকিয়া থাকে লক্ষ লক্ষ বৎসর, অতঃপর তাহাদেরও মৃত্যু। উহাদিগকে বলা হয় নেবুলা। হজরত মুসার জন্মের বৎসর মিশরবাসীরা আকাশে একটি নুতন তারা দেখিয়াছিলেন বলিয়া যে একটি প্রবাদ আছে, সম্ভবত তাহা একটি নেবুলা।
আমাদের সূর্য একটি হলুদ নক্ষত্র (G type)। ইহার বর্তমান তাপমাত্রা ৬ হাজার ডিগ্রী। নিরন্তর তাপ ও আলো ত্যাগ করিয়া উহা ক্রমে নারাঙ্গি ও পরে লাল বর্ণ ধারণ করিবে এবং তখন তাহার তাপমাত্রা দাঁড়াইবে প্রায় তিন হাজার ডিগ্রীতে। কালক্রমে যখন তাহার তাপ ও আলোর সমস্ত সম্বল ফুরাইয়া যাইবে, তখন হইবে তাহার মৃত্যু।
যে দুর্নিবার অগ্নিকাণ্ড সূর্যের ভিতর চলিতেছে, তাহার সামান্য আভাস পাই আমরা তাহার ছড়ানো তাপ ও আলোর তেজ হইতে। বিজ্ঞানীগণ বলেন, পদার্থের ন্যায় এই তেজেরও ওজন আছে। সূর্যের দেহ হইতে প্রতি সেকেণ্ডে যে পরিমাণ তেজ নিঃসৃত হয়, তাহার ওজন প্রায় ৪০ লক্ষ মণ। অর্থাৎ প্রতি সেকেণ্ডে সূর্যের ওজন ৪০ লক্ষ মণ কমিতেছে। আজ এই মুহূর্তে সূর্যের যে ওজন আছে, কাল ঠিক এই সময় তাহা হইতে ওজন কমিয়া যাইবে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টন। নক্ষত্রের অভ্যন্তরে যে প্রলয়কাণ্ড চলিতেছে, তাহারই আঘাতে পরমাণুর বিনাশ ঘটিয়া তেজের উদ্ভব হইতেছে। ইহাতে পরমাণু লোপ পাইয়া যে সুতীব্র তেজের সৃষ্টি হয়, তাহার ওজন ঠিক পরমাণুর ওজনের সমান। নক্ষত্রদের ভাণ্ডার এতই বিশাল যে, তাহার মধ্যে পরমাণু ধংসের উদ্দামতা বহুকাল ধরিয়া চলিতে পারে। এই অপরিমিত লোকসানেও তাহাদের রিক্ত হইতে সময় লাগে বহু কোটি বৎসর। যে পরিমাণ পরমাণুর সঞ্চয় সূর্যের আছে, তাহাতে বর্তমান লোকসানের মাত্রা বজায় রাখিয়াও সে টিকিয়া থাকিবে ১৫ লক্ষ কোটি বৎসর। অতঃপর মহানির্বাণ।
পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্বের বিলুপ্তি ঘটিবে কিন্তু সূর্য নিভিয়া যাইবার বহু কোটি বৎসর আগেই। জন্মাবধি তাপ ত্যাগ করিয়া পৃথিবী দৈনন্দিন ঠাণ্ডা হইতে চলিয়াছে, যদিও সূর্যপ্রদত্ত তাপ প্রাপ্তির ফলে ঘাটতির পরিমাণ অল্প; কিন্তু সূর্য যখন পৃথিবীর আবশ্যকীয় তাপের জোগান দিতে পারিবে না, তখন দ্রুত তাপ ত্যাগ করিয়া পৃথিবী অত্যন্ত ঠাণ্ডা হইয়া পড়িবে। তখন পৃথিবীতে কোথাও জলের নামগন্ধও থাকিবে না, থাকিবে শুধু তুষার। তখন বাতাস বহিবে না, মেঘ হইবে না, বৃষ্টি পড়িবে না, উদ্ভিদকুল জন্মিতে বা বাঁচিতে পারিবে না –ফলে জীবকুলের হইবে অবসান। কলরববিহীন পৃথিবী অন্ধকার আকাশে ভাসিতে থাকিবে অনন্তকাল।
————
৪৮. পৃথিবীর ইতিহাস, ৩য় খণ্ড, দুর্গাদাস লাহিড়ী, পৃ. ১২৫-১৩০।
প্রলয়ের পর পুনঃ সৃষ্টি
মানুষের আশার শেষ নাই, কিন্তু উহা কোনো সময় কাজে লাগে, হয়তো কোনো সময় লাগে না। জীবজগতের সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধানই হইল বাঁচিয়া থাকার আশা। স্বেচ্ছায় কেহই। মরিতে চাহে না, চাহে অমররাজ্য।
আমরা অমররাজ্যের সন্ধান পাই ভারতীয় বৈদিক সাহিত্যের বেদাদি গ্রন্থে এবং অন্যান্য ধর্মসাহিত্যে। এইখানে আমরা সেই অমরজগত সম্বন্ধে কয়েকটি মতের সামান্য আলোচনা করিব।
# বৈদিক মত
হিন্দু ধর্মকে বৈদিক ধর্মও বলা হয়। কেননা হিন্দুদের আসল ধর্মগ্রন্থ বেদ। কিন্তু বর্তমান হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রবহুল ধর্ম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেদের পরে গীতা, পুরাণ, উপপুরাণ ইত্যাদির রচয়িতারা বৈদিক ধর্মের গায়ে রং ফলাইয়াছেন। যে যাহা হউক, অন্যান্য মত আলোচনার পূর্বে দেখা যাক। আলোচ্য বিষয়ে ঋগ্বেদে কি পাওয়া যায়।
ঋগ্বেদের পঞ্চম মণ্ডলের অষ্টাদশ সূক্তের চতুর্থ ঋকে লিখিত আছে, “মানুষ যজ্ঞ দ্বারা স্বর্গলাভে অধিকারী হয়।” যজ্ঞ কি? দেবতার উদ্দেশ্যে মন্ত্র উচ্চারণপূর্বক আগুনে ঘৃত নিক্ষেপ করা। এই কাজটুকু সারিতে পারিলেই স্বর্গ নামক একটি স্থান লাভ হইবে।
ঐ বেদের ষষ্ঠ মণ্ডলের সপ্তচত্বারিংশ সূক্তের সপ্তম ঋকে ইন্দ্রদেবের নিকট প্রার্থনা করা হইতেছে, “হে ইন্দ্রদেব! তুমি আমাদিগকে সেই সুখময় ভয়শূন্য আলোকে অর্থাৎ স্বর্গলোকে লইয়া যাও।” স্বর্গ কি? উহা সুখময় আলোকিত স্থান, যেখানে কোনো বিপদ-আপদ নাই।