সচরাচর একটি সূর্য হইতে আমরা যে তাপ পাইতেছি, তাহার সাত গুণ বা সাতটি সুর্যের তাপ পাইলে জীবাদি দগ্ধ হইতে পারে। কিন্তু তাহার পূর্বেই বলা হইয়াছে যে, জলস্রোতে অত্যুচ্চ পর্বতমালা ভাসমান ও মানুষের গৃহাদি ভূতলশায়ী হইবে। গৃহাদি ভূতলশায়ী হইতে হইলে প্রবল বন্যা আবশ্যক এবং পাহাড়াদি ভাসাইতে যে কতটুকু জলের আবশ্যক, তাহা সহজেই অনুমান করা যায়। উহাতে ভূপৃষ্ঠের কোনো কিছুই অনিমগ্ন থাকিতে পারে না। পক্ষান্তরে জলমগ্ন অবস্থায় উত্তাপের মাত্রা যতই বেশি হউক না কেন, উহাতে কোনো পদার্থই দগ্ন হইতে পারে না, পারে সিদ্ধ হইতে। অতএব বুঝা যায় যে, মহাভারতের প্রলয়ে জীবাদি জ্বলিয়া পুড়িয়া অঙ্গর হইবে এবং ইশিয়ার প্রলয়ে হইবে সিদ্ধ।[৪৮]
.
# মুসলমানদের মত
মুসলমানদের মতে প্রলয় (কিয়ামত) ঘটিবার আগে দজ্জাল নামে এক ভীষণ জন্তুর আবির্ভাব। হইবে এবং পশ্চিমদিক হইতে সূর্যের উদয় হইবে। অতঃপর আল্লাহর আদেশে এস্রাফিল ফেরেশতা শিগায় ফুঁ দিবেন। শিগার ফুঁকে যুগপৎ বিকট শব্দ ও প্রলয়ঙ্করী বায়ুনিঃসারণ হইবে। উহাতে পৃথিবী কাপিয়া উঠিবে, ঘর-বাড়ি, গাছপালা, এমনকি পাহাড়াদি উড়িয়া যাইবে। এবং চন্দ্র-সূর্য ও নক্ষত্রসমূহ ধংসপ্রাপ্ত হইবে। সেই দিনের ভীষণতায় জননী শিশুকে ত্যাগ করিবে, কেহই আপন আপন মূল্যবান বা প্রিয় বস্তু ত্যাগ করিতে কুণ্ঠিত হইবে না। হিংস্র প্রাণীরা হিংস্রভাব ত্যাগ করিবে এবং পরিশেষে প্রাণ বিসর্জনে বাধ্য হইয়া সকলেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবে। স্বর্গ, মর্ত, জ্বীন, ফেরেশতা কিছুই থাকিবে না, এমনকি যে এস্রাফিল ফেরেশতা শিভঙ্গ যুঁকিবেন, তিনিও না। থাকিবেন একমাত্র আল্লাহ।
.
# বিজ্ঞানীদের মত
ধর্মীয় মতে প্রলয়ের বর্ণনায় আমরা দেখিয়াছি যে, কোনো মতে লয় পাইবে শুধু জীবকুল, কোনো মতে জীবদিসহ পৃথিবী, আবার কোনো মতে লয় পাইবে পৃথিবীসহ চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র সবই, অবশিষ্ট থাকিবেন একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। বিজ্ঞানীগণ প্রলয় ঘটিবার যে সমস্ত সম্ভাবনার কথা বলিয়া থাকেন, তাহার মধ্যে কয়েকটি এই —
১. কোনো কারণে যদি কখনও পৃথিবী কক্ষচ্যুত হইয়া পড়ে, তবে প্রলয়ের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু ইহা সসীম। কেননা ইহাতে সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ বা মহাবিশ্বের কোনো ক্ষতি হইবে না, ক্ষতি হইবে শুধু পৃথিবীর।
২. মহাকাশের কোনো নক্ষত্র যদি. সৌরজগতের খুব নিকটবর্তী হইয়া পড়ে, তবে সংঘর্ষের বা আকর্ষণের ফলে প্রলয় ঘটিতে পারে। কিন্তু এইরূপ কোনো ঘটনা ঘটিবে কি না, তাহার নিশ্চয়তা নাই এবং ঘটিলেও আগন্তুক নক্ষত্র ও সৌররাজ্য ব্যতীত অন্য কোনো নক্ষত্র বা মহাবিশ্বের কোনো ক্ষতি হইবে না।
৩. আলো এবং তাপের প্রধান ধর্মই হইল বিকীর্ণ হওয়া। বিকীর্ণ আলো বা তাপ কখনও তাহার উৎসক্ষেত্রে বা কেন্দ্রে ফিরিয়া আসে না, কাজেই এই অপচয় কখনও পূরণ হয় না। পৃথিবীর আলো নাই, কিন্তু তাপ আছে এবং উহা অহর্নিশ হ্রাস পাইতেছে। দৈনন্দিন পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশে তাপমাত্রা কমিবার দরুন ভূপৃষ্ঠের সঙ্কোচনবশত পৃথিবীর কেন্দ্রপ্রদেশের অগ্নিময় তরল ধাতুর বিস্ফোরণ ঘটিতে পারে এবং তাহাতে পৃথিবীর অংশবিশেষ বা সমস্ত পৃথিবীও ধংস হইতে পারে, কিন্তু বিশ্বের অপর কিছু নহে।
৪. মহাবিশ্বের যাবতীয় জ্যোতিষ্ক অর্থাৎ সূর্য, নক্ষত্র, নীহারিকা ইত্যাদি সকলেই অতিশয় উষ্ণ পদার্থ এবং উহারা সকলেই নিয়ত তাপ ত্যাগ করিতেছে। জ্যোতিষ্কপুঞ্জ হইতে এইরূপ তাপ বিকিরণ হইতে হইতে এককালে এমন অবস্থা আসিতে পারে যখন মহাবিশ্বের কোথায়ও তাপের ন্যূনাধিক্য থাকিবে না। হয়তো তখন ঘটিবে বিশ্বব্যাপী মহাপ্রলয়। কিন্তু এইরূপ মহাপ্রলয় হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব না হইলেও উহা আদৌ ঘটিবে। কি না, আর ঘটিলেও তাহা কতকাল পরে ঘটিবে– কোনো বিজ্ঞানীই তাহার নিশ্চয়তা প্রদান করিতে পারেন না।
৫. এই পর্যন্ত প্রলয় সম্বন্ধে বিজ্ঞানভিত্তিক যে সমস্ত সম্ভাবনার বিষয়ে আলোচনা করা হইল, তাহার কোনোটির সম্বন্ধেই বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করিয়া কিছুই বলিতে পারেন না। ইহা ভিন্ন আর একটি সম্ভাবনা আছে, যে বিষয়ে বিজ্ঞানীগণ তাহাদের হিসাবের খাতায় অকপাত করিতে পারেন। সেইটি হইল, সৌরতেজ নিঃশেষ হইয়া সৌরজগতে প্রলয় ঘটিবার সম্ভাবনা।
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, অন্যান্য নক্ষত্রের মতো আমাদের সূর্যও একটি নক্ষত্র। তাই ইহার জন্ম-মৃত্যু ও চরিত্রাদি অন্যান্য নক্ষত্রের মতোই। আকাশে নানা বর্ণের নক্ষত্র দেখা যায়। আকাশ বিজ্ঞানীগণ নক্ষত্রসমূহের পৃষ্ঠদেশের তাপ ও বর্ণ ভেদে নিম্নলিখিতরূপ শ্রেণীবিভাগ করেন —
বর্ণালীর শ্রেণী বর্ণ তাপমাত্রা
O অতি নীল ২০ হাজার ডিগ্রীর উপরে নীল
B নীল ১৪ হাজার ডিগ্রী
A নীলাভ শাদা ১১ হাজার ডিগ্রী
F শাদা ৭ হাজার ৪ শত ডিগ্রী
G হলুদ ৫ হাজার ৮ শত ডিগ্রী
K নারাঙ্গি ৪ হাজার ৬ শত ডিগ্রী
M লাল ৩ হাজার ২ শত ডিগ্রী