.
# সুমেরীয় ‘গিলগামেশ’ কাহিনী
মানব সভ্যতার গোড়ার দিকে যখন সবেমাত্র লেখার প্রচলন হইয়াছে, তখন লেখা হইত কাদামাটি বা গাছের পাতায়। দূর-দূরান্তে সংবাদ আদান-প্রদানের জন্য চিঠি ও পুঁথিপত্তর পাতায়ই লেখা হইত। কোনো লেখাকে দীর্ঘস্থায়ী করিতে হইলে, উহা লেখা হইত পাথর খোদাই করিয়া। কিন্তু উহা বিস্তর শ্রম ও সময়সাপেক্ষ। পক্ষান্তরে কাদামাটির উপরে লেখা যায় সহজে, কিন্তু উহা বেশিদিন স্থায়ী হয় না। ইহার পর আবিষ্কার হইল কাদামাটির চাকতির উপর লিখিয়া ঐগুলিকে পোড়াইয়া কঠিন করা। এককালে ঐ রকম লেখার প্রচলন ছিল সুমের দেশে। তৎকালে ঐ দেশে আসুরবানিপাল নামক একজন বিদ্যোৎসাহী সম্রাট ছিলেন এবং তাহার একটি গ্রন্থাগার ছিল। কালক্রমে ঐ গ্রন্থাগারটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। অধুনা প্রত্নতাত্ত্বিকগণ উক্ত ভগ্নপটি খনন করিয়া প্রাপ্ত হইয়াছেন আসুরবানিপালের গ্রন্থাগারটি ও তন্মধ্যে বহু মৃৎচাকতির গ্রন্থ।
বারোখানা মৃৎচাকতির উপরে লিখিত তিনশত পঙক্তি সমন্বিত গিলগামেশ নামক একখানি মহাকাব্য উদ্ধার করা হইয়াছে, তাহার কতগুলি পাওয়া গিয়াছে নিনেভের ভগ্নস্তূপমধ্যে আসুরবানিপালের গ্রন্থালয়ে। উক্ত গ্রন্থের দ্বিতীয় স্তরে লেখা আছে একটি মহাপ্লাবনের কাহিনী।
ঐ কাহিনীটিতে বলা হইয়াছে– সুদূর অতীতে দেবতারা মানব জাতিকে ধ্বংস করার সংকল্প করিয়া পৃথিবীতে প্লাবন সৃষ্টির জন্য দেবসেনাপতি এলিনকে আদেশ দিয়াছিলেন। দৈবানুগ্রহে পূর্ব হইতে সংবাদ পাইয়া আত্মরক্ষার জন্য উৎনা পিসতিম একটি নৌকা প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছিলেন। অতঃপর বাত্যাদেবতা এনলিন যখন প্লাবন দ্বারা পৃথিবী নিমজ্জিত করিলেন, তখন উৎনা পিসতিম ও তাহার পত্নী সেই বজরায় উঠিয়া প্রাণ রক্ষা করিয়াছিলেন এবং তাহারা জীবকুলের বংশরক্ষার জন্য প্রত্যেক জাতীয় এক এক জোড়া পশু-পাখি নৌকায় তুলিয়া লইয়াছিলেন, সেই জন্যই প্রাণীজাতি ধংস পায় নাই।
একটু আয়াস স্বীকার করিয়া গিলগামেশ মহাকাব্যের প্লাবন কাহিনীর সহিত অন্যান্য দেশের কাহিনী মিলাইয়া দেখিলে বুঝা যাইবে যে, নানান ভঙ্গির কাহিনী সত্ত্বেও উহাদের মধ্যে কিছু না কিছু মিল আছেই।
.
# মূল প্লাবন
এত অধিক প্লাবন কাহিনীর মধ্যে বিশেষ কোনো একটি সত্য, না সবগুলিই সত্য, অথবা সবগুলিই কি মিথ্যা –কয়েক বৎসর আগে পর্যন্ত এই সকল কথার সঠিক উত্তর দেওয়া কাহারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। আলোচ্য প্লাবনের একটি চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে বর্তমান বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে মেসোপটেমিয়ার প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে। উহাতে একটি প্রচণ্ড মহাপ্লাবনের নিদর্শন ভূগর্ভে পাওয়া গিয়াছে, যাহার তুলনা সাধারণ বন্যার সঙ্গে করা চলে না। মাটির নিচে ৮ ফুট পুরু একটি পলিমাটির স্তর আবিস্কৃত হইয়াছে, যাহা অসাধারণ কোনো প্রলয়ঙ্কর প্লাবনের সাক্ষ্য দেয়। আর একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য সুস্পষ্ট প্রমাণ এই যে, পলিস্তরটির নিচের ও উপরের মধ্যে স্থানীয় সংস্কৃতির একটি পূর্ণচ্ছেদ দেখা যায়। এই কথা সত্য যে, বন্যাপ্লাবিত স্থানগুলির সমস্ত সংস্কৃতি বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছিল। পলিস্তরের নিচে পড়িয়া। আছে নব প্রস্তরযুগের গ্রাম্য সংস্কৃতির নিদর্শন –হাতে গড়া বিচিত্র হাঁড়ি-কুড়ি, প্রস্তরাস্ত্র; সেখানে ধাতুদ্রব্যের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় না। কিন্তু সেই পলিস্তরের ঠিক উপরের ভাগেই ধাতুযুগের সম্পূর্ণ নূতন সভ্যতার নানাবিধ উপকরণ দেখিতে পাওয়া যায়। সৌভাগ্যক্রমে প্লাবিত ভূখণ্ডের কোনো কোনো স্থানে দুই সভ্যতার মধ্যে এই রকম পূর্ণচ্ছেদ দেখা যায় না। এমন কতগুলি টিলার মতো উঁচু স্থান ছিল, যাহা প্লাবনেও জলমগ্ন হয় নাই; অথচ সেই স্থানগুলি প্লাবিত ভূখণ্ডেরই অন্তর্গত। এইখানে সংস্কৃতির পূর্বাপর পারম্পর্য নষ্ট হয় নাই। নব প্রস্তরযুগ ধীরে ধীরে কিরূপে ধাতু যুগে রূপান্তরিত হইল, তাহার ধারাবাহিক ইতিহাস রহিয়াছে এইখানের স্তরের মধ্যে সংরক্ষিত। এই রকম স্তর হইতে আরও জানা যায় যে, ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিসের নিম্নভাগে সুমের দেশে প্রস্তরযুগের গ্রামগুলি হইতেই এরেক, এরিদু, লাগাস, উর (হজরত ইব্রাহিমের জন্মস্থান), লারসা প্রভৃতি ঐতিহাসিক নগরগুলির উৎপত্তি হইয়াছিল।
প্রত্নতাত্ত্বিক স্যার লিওনার্ড উলি প্রসঙ্গক্রমে বলিয়াছেন, “এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই যে, আমরা যে বন্যার নিশ্চিত প্রমাণ পাইয়াছি, সেই বন্যাই হইল সুমেরীয় প্রবাদকথার ও ইতিহাসের বন্যা, আবার বাইবেলেরও প্রাবন সেই বন্যা, যে বন্যাকে অবলম্বন করিয়া নোয়ার আখ্যায়িকা রচিত হইয়াছিল।”[৪৭]
————
৪১. পৃথিবীর ইতিহাস, ৩য় খণ্ড, দুর্গাদাস লাহিড়ী, পৃ. ১২৮।
৪২. পৃথিবীর ইতিহাস, ৩য় খণ্ড, দুর্গাদাস লাহিড়ী, পৃ. ১২৫।
৪৩. পৃথিবীর ইতিহাস, ৩য় খণ্ড, দুর্গাদাস লাহিড়ী, পৃ. ১৩০, ১৩১।
৪৪. পৃথিবীর ইতিহাস, ৩য় খণ্ড, দুর্গাদাস লাহিড়ী, পৃ. ১৩১।
৪৫. পৃথিবীর ইতিহাস, ৩য় খণ্ড, দুর্গাদাস লাহিড়ী, পৃ. ১৩১, ১৩২।
৪৬. পৃথিবীর ইতিহাস, ৩য় খণ্ড, দুর্গাদাস লাহিড়ী, পৃ. ১২৬।
৪৭. প্রাচীন ইরাক, শচীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, পৃ. ২৪-২৬, ১৮৮–১৯৩।
১৭. প্রলয়
প্রলয়