.
# প্রাচীন মিশরীয় ও গ্রীসবাসীদের কাহিনী
জলপ্লাবন সম্বন্ধে শাস্ত্রগ্রন্থগুলিতে যেরূপ বর্ণনা দৃষ্ট হয়, প্রাচীন জাতিদিগের অনেকের মধ্যেই সেইরূপ কিংবদন্তী প্রচারিত আছে। উহাতে নাম-ধামাদির পার্থক্য থাকিলেও কিছু না কিছু মিল আছেই।
মিশরীয়গণ বলেন –নুন বা নু নামক বন্যার প্রকোপে পৃথিবীর সমস্ত পদার্থের বীজ জলমগ্ন। ও নষ্ট হইয়া যায়। সেই জলপ্লাবনে ওসিরিস নামক এক ব্যক্তি রক্ষা পাইয়াছিলেন। ওসিরিস যখন আর্ক বা নৌকায় আরোহণ করেন, তখন পৃথিবী অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। কিছুকাল পরে আলোকের উদয় হয় এবং আলোকের সঙ্গে সঙ্গে ভূখণ্ড জাগিয়া উঠে। তখন সমস্ত জীবজন্তু ও উদ্ভিদাদির বীজসহ তিনি ভূতলে অবতরণ করেন। বহি (নৌকা) হইতে অবতরণ করিয়া তিনি প্রথমে দ্রাক্ষালতা রোপণ করেন, অতঃপর মনুষ্যদিগকে কৃষিকার্য শিক্ষা দেন। ধর্ম ও নীতি বিষয়ে মনুষ্যসমাজে তিনিই প্রথম শিক্ষা প্রচার করিয়াছিলেন।
গ্রীসবাসীদের জলপ্লাবনের বর্ণনায় দেখিতে পাওয়া যায় –পৃথিবীতে পাপাচারের বৃদ্ধি দেখিয়া জিউস (গ্রীসবাসীদের ঈশ্বর) বড়ই রুষ্ট হন এবং বন্যার দ্বারা গ্রীসদেশকে প্লাবিত করেন। অত্যুচ্চ পর্বতশৃঙ্গ ভিন্ন সকলই জলমগ্ন হইয়া যায়। সেই সময় একটি আর্ক (নৌকা, মতান্তরে সিন্দুক) প্রস্তুত করিয়া ডিউকেলিয়ন সস্ত্রীক রক্ষা পাইয়াছিলেন। তাঁহার পিতা প্রমিথিউস তাহাকে জলপ্লাবন সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন এবং পিতাই পুত্রকে তরণী নির্মাণ করিতে উপদেশ দেন। নয়দিন কাল জলের উপর সেই তরণী ভাসমান ছিল। অবশেষে পারনাসাস পর্বতের (ইহুদি-খ্রীস্টানরা বলেন অরারট এবং মুসলমানগণ বলেন যুদী পাহাড়) শিখরদেশে ডিউকেলিয়ন অবতরণ করেন।[৪৩]
এই সময় জিউস তাহার নিকট হারমেসকে পাঠাইয়া দেন এবং তাহাকে সাহায্য করিতে প্রতিশ্রুত হন। ডিউকেলিয়ন তখন সেই নির্জন স্থানে মনুষ্যগণকে ও সহচরদিগকে পাঠাইয়া দিবার প্রার্থনা জ্ঞাপন করেন। তদনুসারে জিউস ডিউকেলিয়ন ও তাহার স্ত্রী পীঢ়া, এই উভয়কে শূন্যের দিকে প্রস্তরখণ্ড নিক্ষেপ করিতে বলেন। পীঢ়া যে সকল প্রস্তরখণ্ড নিক্ষেপ করেন, তাহাতে নারী জাতির সৃষ্টি হয় এবং ডিউকেলিয়নের নিক্ষিপ্ত প্রস্তর হইতে পুরুষগণ উৎপন্ন হয়। এই সময় হইতে গ্রীসে প্রস্তর যুগের লোকের অভ্যুদয় হইয়াছিল। ডিউকেলিয়ন আর্ক হইতে অবতরণ করিয়া জিউস ফিক্সিয়স অর্থাৎ পরিত্রাণকর্তা ঈশ্বরের পূজা করিয়াছিলেন।
.
# কালদিয়া ও চীনের কাহিনী
প্রাচীন কালদীয় জাতির মধ্যে জলপ্লাবনের যে বিবরণ প্রচলিত আছে, তাহাতে জানা যায় যে, ইসুগ্রাস রাজার রাজত্বকালে কালদিয়ায় জলপ্লাবন সংঘটিত হইয়াছিল। ওয়ানো নামক দেবতা সেই রাজাকে জলপ্লাবনের বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। ওয়ানো দেবতার ঊৰ্ধভাগ মনুষ্যের ন্যায়, অধোভাগ মীনসদৃশ। সেই দেবতার উপদেশে এক বৃহৎ অর্ণবপোত (নৌকা) প্রস্তুত করিয়া রাজা সপরিবারে আত্মরক্ষা করিয়াছিলেন। বর্তমান মনুষ্যগণ তাহারই বংশধর।
প্রাচীন চীন দেশেও জলপ্লাবনের কাহিনী প্রচারিত আছে। চীনাগণ বলেন যে, সেই ভীষণ জলপ্লাবনে মহাত্মা পয়ান সু সপরিবারে রক্ষা পাইয়াছিলেন এবং তাহাদের বংশাবলীই বর্তমান মানবগোষ্ঠী।[৪৪]
.
# সিরিয়া, কিউবা, পেরু ও ব্রাজিলের কাহিনী
সিরিয়া দেশে জলপ্লাবনের বিষয় প্রচারিত আছে। একটি গুহা দেখাইয়া প্রাচীন সিরিয়াবাসীগণ বলিতেন, এই গুহার মধ্য দিয়া সেই জলপ্লাবনের জল বাহির হইয়াছিল।
কিউবা দ্বীপে জলপ্লাবনের এবং নৌকার সাহায্যে মাত্র কয়েকজন লোকের প্রাণরক্ষার বিষয় প্রচারিত আছে।
পেরু দেশের বিবরণে প্রকাশ, পৃথিবীতে মাত্র ছয়টি মানুষ সেই জলপ্লাবনে রক্ষা পাইয়াছিল।
ব্রাজিলের বিবরণটি বেশ কৌতুকপ্রদ। এম. থেবেট তদ্বিষয় লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন –কেরেবি জাতীয় সুমে একজন সভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। তাহার দুই পুত্র টামেণ্ডোনের ও আরিকোন্ট। সেই দুই পুত্রের মধ্যে পরস্পর সদ্ভাব ছিল না। দুই ভ্রাতা দুইরূপ প্রকৃতিসম্পন্ন ছিল। টামেণ্ডোনের শান্তিপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু আরিকোণ্ট যুদ্ধবিগ্রহ ভালোবাসিতেন। এই হেতু উভয়ে উভয়কে ঘৃণা করিতেন এবং উভয়ে প্রায়ই বিবাদ-বিসম্বাদ ও যুদ্ধ-বিগ্রহ চলিত। একদিন আপনার বল-বিক্রম দেখাইবার জন্য আরিকোন্ট আপনার সহোদরের আবাসভবনের দ্বারদেশ লক্ষ্য করিয়া অস্তনিক্ষেপ করেন। এই ঘটনায় গ্রামকে গ্রাম একেবারে আকাশে উঠিয়া যায়। টামেণ্ডোনের তখন ভূমির উপরে সজোরে আঘাত করেন। সেই আঘাতে ভূগর্ভ হইতে অবিরাম জলস্রোত প্রবাহিত হইতে থাকে। সেই জল আকাশে মেঘমণ্ডল পর্যন্ত উচ্চ হইয়া উঠে এবং তাহাতে পৃথিবী প্লাবিত হয়। টামেণ্ডোনের ও আরিকোট দুই ভাই তখন মিলিত হইয়া পরিবারাদি সঙ্গে লইয়া এক অত্যুচ্চ পাহাড়ে আরোহণ করেন। কিছুকাল পরে জল কমিয়া আসিলে তাহারা পর্বত হইতে অবতরণ করিয়াছিলেন। অবশেষে দুই ভাইয়ের দুই বংশে বিভিন্ন জাতির উৎপত্তি হয়।[৪৫]
.
# ইহুদি, খ্রীস্টান ও মুসলমানদের কাহিনী
তৌরিত গ্রন্থখানা সেমিটিক জাতিরা প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে সকলেই মান্য করিয়া থাকেন। বিশেষত তৌরিতের আদিপুস্তক অংশে বর্ণিত প্লাবনকাহিনীটিকে সকলেই বিশ্বাস করিয়া থাকেন। উক্ত পুস্তকে লিখিত আছে, ঈশ্বর নোয়াকে (হজরত নূহকে) বলিতেছেন, “আর সাত দিন পরে আমি চল্লিশ দিন চল্লিশ রাত্রি অবিরাম বারিবর্ষণ করাইব, যে কোনো প্রাণী, আমি সৃষ্টি করিয়াছি, তাহাদের সমস্ত ধংসপ্রাপ্ত হইবে। পৃথিবীতে কাহারও চিহ্নমাত্র রাখিব না। সেই বৃষ্টির জল পনর হাত উচ্চ হইয়া থাকিবে” ইত্যাদি। ইহার পর ঈশ্বর নোয়াকে নৌকা প্রস্তুত করিয়া সকল প্রাণীর ও সকল সামগ্রীর বীজ তাহাতে রক্ষা করিতে উপদেশ দেন। পরমেশ্বরের আদেশমতো নোয়া নৌকা প্রস্তুত করেন এবং সেই নৌকায় পবিত্র জন্তুদিগের সাতটি পুরুষ ও সাতটি স্ত্রী এবং অপবিত্র জন্তুদিগের দুইটি পুরুষ ও দুইটি স্ত্রী গৃহীত হয়। নোয়া, নোয়ার স্ত্রী এবং হেম, শাম, জাফেট নামক তাহার পুত্রত্রয় ও তাহাদের স্ত্রীগণ সেই নৌকায় আরোহণ করিয়াছিলেন। নানা জাতীয় পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গদি সেই নৌকায় রক্ষিত হইয়াছিল। নোয়ার সেই নৌকায় রক্ষিত মনুষ্যাদি হইতে পুনরায় সংসারে পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ ও বৃক্ষ-লতাদির উদ্ভব হইয়াছে।[৪৬]