সৃষ্টিকর্তা চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্রদের প্রকৃত অবয়ব সম্বন্ধে নিশ্চয়ই অবহিত ছিলেন বা আছেন; অবগত ছিল না শুধু মানুষ, দূরবীন আবিষ্কারের পূর্বে। উহাদের সম্পর্কে এখন মানুষের ধারণার পরিবর্তন হইয়াছে এবং সঠিক জ্ঞান জন্মিয়াছে। সে যাহা হউক, উপরোক্ত বর্ণনাটি মানবীয় জ্ঞানেরই পরিচায়ক, ঐশ্বরিক জ্ঞানের নহে।
আদি (১; ২০-২৪) — “পরে ঈশ্বর কহিলেন, জল নানা জাতীয় জঙ্গম প্রাণীবর্গে প্রাণীময় হউক এবং ভূমির উর্ধে আকাশমণ্ডলের বিতানে পক্ষীগণ উড়ুক। তখন ঈশ্বর বৃহৎ তিমিগণের ও যে নানা জাতীয় জগম প্রাণীবর্গে জল প্রাণীময় আছে, সে সকলের এবং নানা জাতীয় পক্ষীর সৃষ্টি করিলেন। পরে ঈশ্বর দেখিলেন যে, সে সকল উত্তম। আর ঈশ্বর সে সকলকে আশীর্বাদ করিয়া কহিলেন, তোমরা প্রজাবন্ত হও ও বহুবংশ হও, সমুদ্রের জল পরিপূর্ণ কর এবং পৃথিবীতে পক্ষীগণের বাহুল্য হউক। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে পঞ্চম দিবস হইল।”
আদি (১; ২৫-২৭) –“পরে ঈশ্বর কহিলেন, ভূমি নানা জাতীয় প্রাণীবর্গ অর্থাৎ স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী গ্রাম্য পশু, সরীসৃপ ও বন্য পশু উৎপাদন করুক; তাহাতে সেইরূপ হইল। ফলত ঈশ্বর স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী বন্য পশু ও স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী গ্রাম্য পশু ও স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী যাবতীয় ভূচর সরীসৃপ নির্মাণ করিলেন। আর ঈশ্বর দেখিলেন যে, সে সকল উত্তম। পরে ঈশ্বর কহিলেন, আমরা আমাদের প্রতিমূর্তিতে আমাদের সাদৃশ্যে মনুষ্য নির্মাণ করি। আর তাহারা সমুদ্রের মৎস্যদের উপরে, আকাশের পক্ষীদের উপরে, পশুগণের উপরে, সমস্ত পৃথিবীর উপরে ও ভূমিতে গমনশীল যাবতীয় সরীসৃপের উপরে কর্তৃত্ব করুক। পরে ঈশ্বর আপনার প্রতিমূর্তিতে মনুষ্যকে সৃষ্টি করিলেন, ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতেই তাহাকে সৃষ্টি করিলেন। … আর সন্ধ্যা ও। প্রাতঃকাল হইলে ষষ্ঠ দিবস হইল।”
পূর্বোক্ত বিবরণগুলিতে জানা যায় যে, ঈশ্বর পঞ্চম দিনে সৃষ্টি করিলেন জগতের যাবতীয় জলচর ও খেচর প্রাণী এবং ষষ্ঠ দিনের সম্ভবত সকাল বেলা সৃষ্টি করিলেন যাবতীয় ভূচর প্রাণী। ঐ সমস্ত জীব সৃষ্টি করিতে ঈশ্বর কোনোই উপাদান ব্যবহার করেন নাই, ব্যবহার করিয়াছেন শুধু কথা। বিশেষত কোনো প্রাণী সৃষ্টি করিতেই তাহার একাধিক দিন সময় লাগে নাই। আর অধুনা একটি হস্তী সৃষ্টি করিতে দুই বৎসর, একটি মানুষ বা গরু সৃষ্টি করিতে নয় মাস (চলিত কথায় দশ মাস), একটি ছাগল ছয় মাস, কুকুর তিন মাস এবং একটি মশা সৃষ্টি করিতেও ঈশ্বরের প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লাগে।
ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করিলেন সম্ভবত ষষ্ঠ দিনের বিকাল বেলা, নিজের আকৃতিতে। এই অনুচ্ছেদে তিনবারই উল্লিখিত হইয়াছে যে, ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করিলেন নিজের প্রতিমূর্তিতে। ইহাতে বুঝা যায় যে, ঈশ্বর মানুষের আকৃতিবিশিষ্ট জীব। কেননা আদিপুস্তকের ১; ২-এ লিখিত আছে যে, ঈশ্বরের আত্ম জলের উপর অবস্থিতি করিতেছিলেন। যে ঈশ্বর মানুষের। আকৃতিবিশিষ্ট এবং আত্মা বা জীবন ধারণ করেন, তিনি হ’ন জীবশ্রেণীভুক্ত এবং তিনি নিরাকার নহেন, নরাকার।
আদি (২; ১/১) –“এইরূপে আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী এবং বস্তুব্যুহ সমাপ্ত হইল। পরে ঈশ্বর সপ্তম দিনে আপনার কৃতকার্য হইতে নিবৃত্ত হইলেন। সেই সপ্তম দিনে আপনার কৃত সমস্ত কার্য হইতে বিশ্রাম করিলেন।”
ছয় দিন কাজ করিয়া ঈশ্বর সপ্তম দিনে বিশ্রাম করিলেন। অসীম শক্তিসম্পন্ন নিরাকার ঈশ্বরের পক্ষে না হইলেও নরাকার ঈশ্বরের পক্ষে পরিশ্রমে ক্লান্ত হওয়া স্বাভাবিক, কাজেই বিশ্রাম আবশ্যক। হয়তো কেহ বলিতে পারেন যে, ঐ বিশ্রাম তাঁহার কায়িক বা মানসিক শ্রান্তিজনিত নহে, উহা তাঁহার কার্য হইতে বিরত থাকা।
আলোচ্য ছয় দিনে ঈশ্বর সৃষ্টি করিয়াছিলেন একটি চন্দ্র, একটি সূর্য, একটি পৃথিবী ও হাজার ছয়েক নক্ষত্র (ছয় হাজারের বেশি নক্ষত্র খালি চোখে দেখা যায় না) এবং যাবতীয় জীবের এক এক জোড়া করিয়া জীব মাত্র। আর বর্তমানে মহাকাশে দেখা যাইতেছে দশটি পৃথিবী (গ্রহ), গোটা ত্রিশেক চন্দ্র (উপগ্রহ) ও হাজারো কোটি সূর্য (নক্ষত্র)। হয়তো ঐ সকল সূর্যেরও গ্রহ-উপগ্রহ থাকিতে পারে। ইহাতে দেখা যাইতেছে যে, ঈশ্বর এই সকল সৃষ্টি করিয়াছেন আদিসৃষ্টির পরে এবং এখনও মহাকাশে নূতন নূতন নক্ষত্র ও নীহারিকা সৃষ্টি করিতেছেন। আর জীবসৃষ্টি ঈশ্বর ঐ ছয়দিনে যাহা করিয়াছেন, বর্তমানে প্রতি মিনিটে করেন তাহার চেয়ে বেশি। মশা, মাছি বা পিপীলিার কথা তুলিলাম না। আলোচ্য ছয়দিনে ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করিয়াছিলেন মাত্র দুইটি, আর বর্তমানে প্রতি মিনিটে সৃষ্টি করিতেছেন প্রায় ৪২টি। তথাপি সেই দিন হইতে এখন পর্যন্ত ৫,৯৭৪ বৎসরে তিনি দ্বিতীয়বার বিশ্রামের নামও লইলেন না (বাইবেলের মতে, আদম বা জগত সৃষ্ট হইয়াছিল খ্রী. পূ. ৪০০৪ সালে[২] এবং বর্তমানে ১৯৭০ সাল)।
আজ প্রত্যেক ব্যক্তি অবগত আছেন যে, লোকসংখ্যা অত্যধিক বৃদ্ধির ফলে ক. পৃথিবীময় খাদ্যসংকট দেখা দিয়াছে এবং উহার প্রতিকারের জন্য রাষ্ট্রনেতাগণ জন্মনিয়ন্ত্রণ বিধি প্রবর্তনে বাধ্য হইতেছেন। ইহাতে মানব জাতির ভবিষ্যত কল্যাণের পথ পরিষ্কার হইতেছে বটে, কিন্তু গোড়া ধার্মিকগণ ইহাতে ‘মহাপাপ মহাপাপ’ বলিয়া হৈ চৈ করিতেছেন। এমতাবস্থায় ঈশ্বর যদি প্রতি সপ্তাহের বিশ্রামবারে অন্তত মানুষ সৃষ্টির কাজে বিরত থাকিয়া বিশ্রাম লইতেন, তবে বিশ্বমানবের অশেষ কল্যাণ সাধিত হইত।