মহাকাশের নীল রংটি সমুদ্রের জলে প্রতিফলিত হওয়ায় সমুদ্রের জল নীলবর্ণ বলিয়া ভ্রম হয়। সাগরজলের এই বর্ণটি আকাশে দেখিয়া একদল মানুষ মনে করিতেন, আকাশ জলের তৈয়ারী। তাহারা আরও মনে করিতেন –আকাশ প্রথমটি জলের, দ্বিতীয়টি লৌহের, তৃতীয় তারে, চতুর্থ স্বর্ণের ইত্যাদি। তাহারা জানিতেন না যে, সূর্যরশ্মির সপ্তবর্ণের একটি বর্ণ (নীল বর্ণ) বায়ুস্তরে আটকা পড়ায় ঐ নীল বর্ণের সৃষ্টি হইয়াছে।
আদি (১; ২) –“পৃথিবী ঘোর ও শূন্য ছিল এবং অন্ধকার জলধির উপরে ছিল আর ঈশ্বরের আত্মা জলের উপর অবস্থিতি করিতেছিলেন।” (এই বর্ণনাটি মনুসংহিতার ১; ৮-এর বর্ণনার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ)।
আলোচ্য সময় পর্যন্ত মাত্র দুইটি বস্তুই সৃষ্ট হইয়াছিল। একটি আকাশ, অপরটি পৃথিবী। অথচ এইখানে বলা হইতেছে যে, “পৃথিবী অন্ধকার জলধির উপরে ছিল”, এই জলধিটি বানাইল কে এবং কোন্ সময়ে, তাহা বুঝা যায় না।
পৃথিবীর সব অঞ্চলেই মাটিতে গর্ত বা কূপ খনন করিলে (বিভিন্ন গভীরতায়) জল পাওয়া যায়। ইহা দেখিয়াই বোধ হয় সেকালের লোকে মনে করিত, পৃথিবী জলের উপর অবস্থিত।
আদি (১; ৩-৫) –“পরে ঈশ্বর কহিলেন, ‘দীপ্তি হউক; তাহাতে দীপ্তি হইল। তখন ঈশ্বর দীপ্তি উত্তম দেখিলেন এবং ঈশ্বর অন্ধকার হইতে দীপ্তি পৃথক করিলেন। আর ঈশ্বর দীপ্তির নাম ‘দিবস’ ও অন্ধকারের নাম ‘রাত্রি’ রাখিলেন। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে প্রথম দিবস হইল।”
এইখানে দেখা যায় যে, সূর্য সৃষ্টির আগে শুধু ঈশ্বরের মুখের কথায়ই সন্ধ্যা ও সকাল অর্থাৎ দিন ও রাত্রি হইল।
আদি (১; ৬-৮) –“পরে ঈশ্বর কহিলেন, জলের মধ্যে বিতান (শূন্য) হউক ও জলকে দুইভাগে পৃথক করুক। ঈশ্বর এইরূপে বিতান করিয়া বিতানের উদ্ধৃস্থিত জল হইতে বিতানের অধঃস্থিত জল পৃথক করিলেন। তাহাতে সেইরূপ হইল। পরে ঈশ্বর বিতানের নাম আকাশমণ্ডল রাখিলেন। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে দ্বিতীয় দিবস হইল।”
এইখানে কি যে বলা হইল, সহজবুদ্ধি মানুষের পক্ষে তাহা বুঝা কঠিন।
আদি (১; ৯-১০) — “পরে ঈশ্বর কহিলেন, আকাশমণ্ডলের নীচস্থ সমস্ত জল একস্থানে সংগৃহীত হউক ও স্থল সপ্রকাশ হউক; তাহাতে সেইরূপ হইল। তখন স্থলের নাম ভূমি ও জলরাশির নাম সমুদ্র রাখিলেন।”
এইখানে বলা হইতেছে যে, আকাশমণ্ডলের নীচস্থ সমস্ত জল একস্থানে সংগৃহীত হউক। তাহাই যদি হয় তবে ভিন্ন ভিন্ন সমুদ্র, নদ-নদী ও হ্রদাদির সৃষ্টি হইল কি রকমে!
আদি (১; ১১-১৩) — “পরে ঈশ্বর কহিলেন, ভূমি, তৃণ, বীজোৎপাদক ওষধি ও সবীজ স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী ফলের বৃক্ষ ভূমির উপরে উৎপন্ন হউক; তাহাতে সেইরূপ হইল। ফলত ভূমি তৃণ, স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী বীজোৎপাদক ওষধি ও স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী সবীজ ফলের উৎপাদক বৃক্ষ উৎপন্ন করিল। আর ঈশ্বর দেখিলেন যে, সে সকল উত্তম। আর সন্ধ্যা আর প্রাতঃকাল হইলে তৃতীয় দিন হইল।”
এইখানে দেখা যাইতেছে যে, সৃষ্টির তৃতীয় দিনে তৃণ ও গাছপালা জন্মিল। কিন্তু এই সময় পর্যন্ত সূর্য ও বাতাস সৃষ্টি হওয়ার কোনো বিবরণ নাই। অধুনা দেখা যাইতেছে যে, সূর্যালোক ও বাতাস (কার্বন ডাই-অক্সাইড) ভিন্ন কোনো উদ্ভিদ জন্মিতে বা বঁচিতে পারে না। সেই সময় উহা সম্ভব হইল কি রকমে!
আদি (১; ১৪–১৯) –“পরে ঈশ্বর কহিলেন, রাত্রি হইতে দিবসকে বিভিন্ন করণার্থে আকাশমণ্ডলের বিতানে জ্যোতির্গণ হউক। সে সমস্ত চিহ্নের জন্য, ঋতুর জন্য এবং দিবসের ও বৎসরের জন্য হউক এবং পৃথিবীতে দীপ্তি দিবার জন্য দীপ বলিয়া আকাশমণ্ডলের বিতানে থাকুক; তাহাতে সেইরূপ হইল। ফলত ঈশ্বর দিনের উপর কর্তৃত্ব করিতে এক মহাজ্যোতি ও রাত্রির উপর কর্তৃত্ব করিতে তদপেক্ষা ক্ষুদ্র এক জ্যোতি, এই দুই বৃহৎ জ্যোতি এবং নক্ষত্রসমূহ নির্মাণ করিলেন। আর পৃথিবীতে দীপ্তি দিবার জন্য এবং দিবস ও রাত্রির উপরে কর্তৃত্ব করণার্থে এবং দীপ্তি হইতে অন্ধকার বিভিন্ন করণার্থে ঈশ্বর ঐ জ্যোতিসমূহকে আকাশমণ্ডলের বিতানে স্থাপন করিলেন এবং ঈশ্বর দেখিলেন যে, সে সকল উত্তম। আর সন্ধ্যা আর প্রাতঃকাল হইলে চতুর্থ দিবস হইল।”
প্রিয় পাঠকগণের স্মরণ থাকিতে পারে যে, আদিপুস্তকের ১; ৩–৫-এ লিখিত আছে, “পরে ঈশ্বর কহিলেন, ‘দীপ্তি হউক; তাহাতে দীপ্তি হইল। … আর ঈশ্বর দীপ্তির নাম দিবস ও অন্ধকারের নাম রাত্রি রাখিলেন।” এইখানে আবার দেখা যায় যে, চাঁদ, সূর্য ও নক্ষত্রের দ্বারা দীপ্তি সৃষ্টি করিলেন, দীপ্তি হইতে অন্ধকার ভিন্ন করিয়া পুনঃ দিন ও রাত্রি সৃষ্টি করিলেন।
প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়, এই তিনটি ‘দিন’-এর সৃষ্টি হইয়াছিল ঈশ্বরের মহিমা বা কুদরতি আলোকে এবং চতুর্থ দিবসটির সৃষ্টি হইল সৌরালোকে। সূর্যের আলো ও কুদরতি আলো– ইহাতে পার্থক্য কি এবং কুদরতি আলোয় দিন হওয়ার নিয়ম বাতিল করিয়া সৌরালোকে দিন হওয়ার নিয়ম কেন কায়েম করা হইল, তাহা বুঝা মুশকিল। কুদরতি আলোকে তাপ ছিল না, তাই উহা জীবজগতের অনুকূলও ছিল না; বোধ হয় এই কারণেই উহা বাতিল করা হইয়াছে।
আজকাল শিক্ষিত ব্যক্তি মাত্রই জানেন যে, নক্ষত্রগণ কেহই ক্ষুদ্র আলোর বিন্দু নহে। উহারা প্রত্যেকেই এক একটি সূর্য। কোনো কোনো নক্ষত্র সূর্য অপেক্ষা ছোট, কিন্তু অধিকাংশই সূর্য অপেক্ষা বড়। কোনো কোনো নক্ষত্র সূর্য অপেক্ষা হাজার, লক্ষ বা কোটি কোটি গুণ বড়। সূর্যের ব্যাস মাত্র (প্রায়) ৮ লক্ষ ৬৬ হাজার মাইল। কিন্তু মহাকাশে বেটেল জিউস নামক নক্ষত্রটির ব্যাস প্রায় ২১ কোটি মাইল। কয়েক লক্ষ সূর্য উহার পেটের মধ্যে লুকাইয়া থাকিতে পারে। Omicron Ceti নামক নক্ষত্রটি আয়তনে প্রায় তিন কোটি সূর্যের সমান এবং অ্যান্টারেস নামক নক্ষত্রটির আয়তন প্রায় ১০ কোটি সূর্যের সমান। পক্ষান্তরে চন্দ্র এতোধিক ছোট যে, নক্ষত্রদের সহিত উহার। তুলনাই হয় না। যেহেতু ৫০টি চন্দ্র একত্রিত না করিলে পৃথিবীকে পড়া যায় না এবং পৃথিবী হইতে সূর্য প্রায় ১৩ লক্ষ গুণ বড়। অর্থাৎ চন্দ্র সূর্যের সাড়ে ছয় কোটি ভাগের এক ভাগ মাত্র। অথচ কোটি কোটি অতিকায় মহাজ্যোতিষ্কদের সাধারণ নক্ষত্র বলিয়া, চন্দ্র ও সূর্যকে বলা হইয়াছে “এই দুই বৃহৎ জ্যোতি”। অর্থাৎ মানুষ তাহার সাধারণ দৃষ্টিতে যেরূপ দেখিয়া থাকে, উহা তাহাই।