শিশুমনে কুসংস্কারের বীজ ছড়ায় তাহাদের মাতা-পিতা ও গুরুজন, নানারূপ দেও, পরী ও ভূতের গল্প বলিয়া। যদিও বাস্তব জগতে ঐগুলির কোনো অস্তিত্ব নাই, তথাপি একদল মানুষ উহা বিশ্বাস করে ও তাহাদের সন্তান-সন্ততি বা শিষ্যাদির মধ্যে উহার বীজ ছড়ায়। কেননা ঐ সকল অলীক কাহিনী শিশুমনেই দাগ কাটে বেশি।
এমন একটি যুগ ছিল, যখন মানুষ ছিল তাহার জাতিগত জীবনে শিশু। সেই মানব সভ্যতার শিশুকালে তৎকালীন মোড়ল বা সমাজপতিগণ যাহা বলিতেন, জনসাধারণ তাহা অভ্রান্ত বলিয়া বিশ্বাস ও মান্য করিত; তা বাক্যটি যতই অদ্ভুত হউক না কেন। বর্তমান কালেও কোনো কোনো মহলে দেখা যায়– সত্য-মিথ্যার বিচার নাই, গুরুবাক্য শিরোধার্য। এইখানে আমরা ঐরূপ কতিপয় গুরুবাক্যের অবতারণা করিব, ইহার কোটি সংস্কার এবং কোটি কুসংস্কার, তাহা যাচাই করিবেন সুধী পাঠকবৃন্দ।
.
# দেবতা
হয়তো কোন দেশের কোনো সমাজপতি কল্পনা করিলেন যে, সূর্যের বদৌলতে আমরা তাপ পাই, আলো পাই, বাগান বা ক্ষেতের ফসল পাই এবং উহার দ্বারা আরো কত রকমে উপকৃত হই, সুতরাং উহাকে তুষ্ট না রাখিলে চলে না। তিনি শুরু করিলেন সূর্যের স্তব-স্তুতি, আর জনসাধারণ উহা মানিয়া লইল এবং আরম্ভ হইল সূর্যপূজা। মেক্সিকোর আদিম অধিবাসীরা তো সূর্যের নামে নরবলি প্রথারই প্রচলন করিয়াছিল এবং হাজার হাজার বৎসরে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন নষ্ট হইয়াছে উহাদের সূর্যদেবকে তুষ্ট করার জন্য। দেব-দেবী বা ঈশ্বরের নামে নরবলির বদলে পশুবলির প্রথা প্রায় সব দেশেই আজও প্রচলিত আছে।
শুধু মেক্সিকোতেই নহে, অন্যান্য দেশেও নরবলি প্রথার প্রমাণ পাওয়া যায়। ইহুদিদিগের মধ্যে জাভে-এর তৃপ্তির জন্য নরবলি দেওয়ার প্রচলন ছিল। জজদের যুগে দেখা যায় নবী শামুয়েল বন্দী রাজা আগাগকে প্রভুর নামে স্বহস্তে বলি দিয়াছিলেন (Samuel 15), জেফত তাহার কন্যাকে বলি দিয়া যজ্ঞে আহুতিদান করিয়াছিলেন (Judges II) এবং হজরত ইব্রাহিম তাঁহার পুত্রকে কোরবানি দিতে উদ্যত হইয়াছিলেন। ভারতেও এক সময়ে নরবলির প্রথা ছিল, তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ গ্রন্থের কাঁপালিক চরিত্রে।
কোনো দেশের কোনো মুরুব্বি ব্যক্তি হয়তো কল্পনা করিলেন যে, সূর্যের কাছে আমরা অশেষ উপকার প্রাপ্ত হই বটে; কিন্তু উহাকে তো আর হাতের কাছে পাই না! সূর্যের প্রায় সকল গুণই পাওয়া যায় অগ্নির মধ্যে, বস্তুত অগ্নি সূর্যেরই প্রতিরূপ। সুতরাং অগ্নিদেবের তুষ্টার্থে তাঁহার জপ-তপ করাই কর্তব্য। আর তাহার ঐ মত মানিয়া জনসাধারণ আরম্ভ করিল অগ্নিপূজা। হিন্দু ও পারসিকদের মতে, অগ্নি অতীব পবিত্র এবং পরম দেবতা।
আদিম মানব সহজ ও সরল মনেই প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তির উপাসনা শুরু করিয়াছিল। তাহাদের ঐ সকল উপাসনার মূলে ছিল বাঁচিয়া থাকার কামনা, স্বর্গপ্রাপ্তি নহে। অনুকূল শক্তিসমূহের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও প্রতিকূল শক্তিকে বশ করিবার প্রচেষ্টাই ছিল আদিম মানবদের প্রকৃতিপূজার মূল উদ্দেশ্য। আবার বিরাট ও বিশাল কিছু দেখিলেই তাহার কাছে তাহারা মস্তক অবনত করিত। বিশেষত প্রত্যেক শক্তিকেই কল্পনা করা হইত ব্যক্তিরূপে। উহারা যেন সকলেই মানুষের মতো আকৃতি-প্রকৃতি বিশিষ্ট এবং ইচ্ছাশক্তির অধিকারী। উহারা ইচ্ছা করিলে যেন মানুষের উপকার বা অপকার দুইই করিতে পারে। এইরূপ বিশ্বাসের বশবর্তী হইয়া আদি মানব শুধু সূর্য ও অগ্নিকেই দেবত্ব দেয় নাই, দেবত্ব দিয়াছিল জল, বায়ু, সাপ, কুমির, বাঘ, নদী, সাগর, পাহাড়, নক্ষত্র, মেঘ, বৃষ্টি, ঝঞ্ঝা, বস্ত্র, বটবৃক্ষ এবং কোনো কোনো পশু পাখিকেও।
ঐসব পার্থিব দেবতা ভিন্ন কতগুলি অপার্থিব দেবতারও কল্পনা হইয়াছিল। যেমন– ক্রোধের দেবতা রুদ্র, সাম্যের দেবতা বিষ্ণু, সম্পদের দেবী লক্ষ্মী, বিদ্যাদেবী সরস্বতী ইত্যাদি। আবার কোনো কোনো দেশে মানুষকেও দেবাসনে বসানো হইয়াছে, কোথায়ও মহামানব বা কোথায়ও দেব-অবতাররূপে। যেমন –শ্রীরাম, শ্রীকৃষ্ণ, নমরুদ, ফেরাউন ইত্যাদি (ফেরাউন কোনো ব্যক্তিবিশেষের নাম নহে, উহা রাষ্ট্রীয় উপাধি মাত্র)।
আদিম মানবদের ঈশ্বরকল্পনা ছিল না, কল্পনা ছিল দেবতার। যে তাপ ও আলো দান করে, সে একজন দেবতা; যে খাদ্য দান করে, সে একজন দেবতা; যে বৃষ্টি দান করে, সে একজন দেবতা; এইরূপ– ঝঞ্ঝার দেবতা, বজ্রের দেবতা, মৃত্যুর দেবতা ইত্যাদি অজস্র দেবতা। মনে করা হইত যে, দেবতারা সকলেই এক একটি কার্য নির্বাহ করিয়া থাকেন স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে। কাজেই উহারা প্রত্যেকেই এক একটি বিষয়ের মালিক। অর্থাৎ বিভাগীয় ঈশ্বর (Departmental God) পরবর্তী কালের মানুষ কল্পনা করিল যে, ঐ সকল ভিন্ন ভিন্ন শক্তির মূলে একটি মহাশক্তি আছে, তখন তাহার নাম রাখা হইল বিশ্ব অধিপতি বা পরম ঈশ্বর। কিন্তু দেখা গেল যে, পরম ঈশ্বর তো স্বহস্তে কিছুই করেন না, তবে প্রকৃতির যাবতীয় ঘটনা ঘটে কি রকম? তখন কল্পনা করা হইল যে, যাবতীয় কার্য নির্বাহ ঐ সকল দেবতারাই করিয়া থাকেন বটে, কিন্তু পরমেশ্বরের হুকুমমতে। দেবতারা সকলেই পরমেশ্বরের নির্দেশমতে নিজ নিজ কর্তব্য পালন করিয়া থাকেন মাত্র। তবে আগের পরিকল্পনাটি একটু পরিবর্তন করা হইল। দেবতারা ছিলেন ৩০-৪০ কোটি বা নির্দিষ্ট সংখ্যক, কিন্তু স্বর্গীয় দূতেরা অসংখ্য। পরমেশ্বর বা একেশ্বর কল্পনার পূর্বে যাহারা ছিলেন। দেবতা, একেশ্বর কল্পনার পরে তাহারাই বনিয়াছেন স্বর্গীয় দূত। প্রাচীন মানবের এই স্বর্গদূত পরিকল্পনাটি পরে স্থান পাইয়াছে কতগুলি ধর্মে।