মন্থন শেষ হইলে মহাদেব পুনরায় সমুদ্র মন্থনে প্রবৃত্ত হন এবং তাহাতে ভীষণ হলাহল (বিষ)-এর উৎপত্তি হয়। সেই বিষ এতই অত্যুগ্র যে, ধরিত্রীর কোথায়ও উহা রাখিলে, বিষের জ্বালায় সেই স্থান জ্বলিয়া-পুড়িয়া ছারখার হইয়া যাইবে। অগত্যা মহাদেব স্বয়ং উহা পান করিলেন। কিন্তু গলাধঃকরণ করিলেন না, কণ্ঠে ধারণ করিলেন; তাহাতে তাহার কণ্ঠ হইল নীলবর্ণ। তাই মহাদেবের এক নাম নীলকণ্ঠ।
বর্তমান জগতের বিজ্ঞানীদেবগণ পারমাণবিক শক্তিসমুদ্র মন্থন করিয়া অমৃত উৎপন্ন করিলে পৃথিবী হইবে মানুষের অমরাপুরী, না হইলেও শান্তিনিকেতন। কিন্তু মহাদেব বিজ্ঞানীরা হলাহল উৎপন্ন করিলে, উহার জ্বালায় পৃথিবী জুলিয়া পুড়িয়া হইবে অগ্নিকুণ্ড বা নরকপুরী, যাহাকে বিজ্ঞানী অ্যাস্টন বলিয়াছেন ‘জ্বলন্ত নক্ষত্র’। উহাকে নীলকণ্ঠের মতো আয়ত্তাধীনে আনিবার ক্ষমতা বিজ্ঞানী। মহাদেবদের হইবে কি?
————
২৯. প্রাচীন মিশর, শচীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, পৃ. ৪৮।
৩০. পৃথিবীর ইতিহাস, দেবীপ্রসাদ, পৃ. ১৯৮, ১৯৯।
৩১. প্রাচীন ইরাক, শচীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, পৃ. ৫, ৬।
৩২, প্রাচীন ইরাক, শচীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, পৃ. ১০।
৩৩. বিশ্বের উপাদান, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, পৃ. ৪২।
১৪. সংস্কার ও কুসংস্কার সৃষ্টি
সংস্কার ও কুসংস্কার সৃষ্টি
প্রত্নতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের সহায়তায় যে মানবেতিহাস প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহাতে জানা যায় যে, মানুষের জাতিগত জীবনের শৈশবে মানুষ ও ইতর জীবের আহার-বিহার ও মনোবৃত্তির বিশেষ কোনো পার্থক্য ছিল না। সভ্যতার উষালোকপ্রাপ্তির সাথে সাথে পার্থক্যটি প্রকট হইয়া উঠিয়াছে। তখনকার দিনে যেমনই চলিয়াছিল পশুবৃত্তি দূরীকরণ অভিযান, অর্থাৎ মানুষের সমাজ সংস্কার, আবার তেমনই উহার সহগামী হইয়া চলিয়াছিল শত শত কুসংস্কার। সেইদিনের মানুষের নিছক কল্পিত বিষয় বা কাহিনীগুলি পরবর্তী মানুষের মনে এমনই গভীরভাবে দাগ কাটিয়াছে যে, হাজার হাজার বৎসর পরেও কতক মানুষ ঐগুলিকে ধ্রুব সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিয়া আসিতেছে।
মানব সভ্যতার মধ্যযুগে গ্রীস, মিশর, ব্যাবিলন, চীন ও ভারতাদি অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশসমূহে চলিয়াছিল মানুষের কল্পনাপ্রসূত নানাবিধ জপ, তপ, হোম, বলি ও নানাবিধ ক্রিয়ানুষ্ঠানাদি কুসংস্কারের প্রবল বন্যা এবং উহাই ছিল সেইদিনের মানুষের ধর্ম। ধর্ম তখনও স্বতন্ত্র রূপ লইয়া মানব সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে নাই। বলা বাহুল্য যে, সেইদিনের কোনো। ক্রিয়ানুষ্ঠানাদিতে অবশ্যকরণীয় বলিয়া কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। মানুষ তাহার স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যেই প্রকৃতির নানারূপ শক্তির স্তব-স্তুতি করিত স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হইয়া স্বাধীনভাবে। এইটা কর, ওইটা করিতে হইবে’ –এই বলিয়া কোনো চাপ ছিল না কোনো ব্যক্তির উপরে।
কালক্রমে যখন অঞ্চলবিশেষের সমাজপতিগণ কতক পূর্বপ্রচলিত ও কতক স্বকল্পিত ক্রিয়ানুষ্ঠানাদিকে অবশ্যকরণীয় বলিয়া প্রচার করিলেন, তখন হইতে তৈয়ারী হইল নিত্য নৈমিত্তিক কর্মতালিকা বনাম ‘ধর্ম’ নামের সূচনা।
ধর্মবেত্তারা সকলেই যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছেন কুসংস্কার বর্জন করিতে। তাই দেখা যাইতেছে যে, যে ধর্ম অপেক্ষাকৃত আধুনিক, সেই ধর্ম কুসংস্কারমুক্ত এবং যে ধর্ম পুরাতন, সেই ধর্ম কুসংস্কারে ভরপুর।
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, আমরা বাস করিতেছি বিরাট এক বায়ুচাপের মধ্যে, যে চাপে পাথরাদি গুড়া হইয়া যাইতে পারে। কথাটি সত্য। কিন্তু আমরা তাহা টের পাইতেছি না। কেননা আমাদের শরীরের বাহিরে যেমন বায়ু আছে, ভিতরেও তেমন বায়ু আছে; ভিতর ও বাহিরের বায়ুর চাপে ঐ চাপ কাটাকাটি হইয়া যায়। বিশেষত জন্মাবধি বায়ুচাপে বাস করিয়া ঐ চাপ হইয়াছে আমাদের। অভ্যাসাগত। কাজেই আমরা অনুভব করিতে পারতেছি না যে, বায়ুর চাপ আছে।
বায়ুচাপের মতোই মানুষের অভ্যাসাগত কুসংস্কার। দূর অতীতের ধর্মবেত্তারা ছিলেন নানাবিধ কুসংস্কারপূর্ণ সমাজের বাঁশিন্দা। তাহাদের ভিতর ও বাহিরে ছিল কুসংস্কার এবং জন্মাবধি কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে বাস করিয়া কিছু হইয়াছিল গা-সহা অভ্যাস। তাই অনেক ধর্মবেত্তাই কু সংস্কার কি ও কোনটি, তাহা অনুধাবন করিতেই পারেন নাই। কাজেই কুসংস্কার বর্জনের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কতক ধর্মবেত্তা বহুক্ষেত্রে ঝোঁপ কাটিয়া জঙ্গল রোপণ করিয়া গিয়াছেন। বলা বাহুল্য যে, কোনো কুসংস্কারই কুসংস্কার বলিয়া সর্বস্তরের লোকের কাছে স্বীকৃতি লাভ করে না।
কুসংস্কার কি, অল্প কথায় ইহার উত্তর হইল, যুক্তিহীন বিশ্বাস বা অসার যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত মতবাদে বিশ্বাস; এক কথায় –অন্ধবিশ্বাস। যেখানে কোনো বিষয় বা ঘটনা সত্য কি মিথ্যা, তাহা যাচাই করিবার মতো জ্ঞানের অভাব, সেখানেই কুসংস্কারের বাসা। অসভ্য, অর্ধসভ্য, অশিক্ষিত ও শিশু মনেই কুসংস্কারের প্রভাব বেশি। কিন্তু কুসংস্কার এত ব্যাপকভাবে ছড়াইয়া আছে যে, সম্পূর্ণ কুসংস্কারমুক্ত মানুষ অল্পই পাওয়া যায়। যাহারা নিজেদের কুসংস্কারমুক্ত বলিয়া গর্ববোধ করেন, হয়তো কোনো না কোনো রূপে তাহাদের ভিতরেও কিছু না কিছু কুসংস্কার লুকাইয়া থাকিতে পারে বা আছে।