বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকের আইনস্টাইনের সূত্র ও অন্যান্য বিজ্ঞানীদের কল্পনাসমূহ পরবর্তী বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফলে বাস্তব রূপ পাইল কয়েক বৎসরের মধ্যেই। জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড, ডেনমার্ক প্রভৃতি ইউরোপীয় দেশের ও কানাডার বহু বিজ্ঞানীই পরমাণু ভাঙ্গিয়া উহার। শক্তি সংগ্রহের জন্য নানারূপ গবেষণা করিতে থাকেন এবং বিজ্ঞানী অটোহান ও স্ট্রাসমান পরমাণু ভাগিতে সক্ষম হন। এই সময়টিতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূচনা হয় এবং হিটলারের স্বেচ্ছাচারিতায় উত্ত্যক্ত হইয়া জার্মানি, ইতালি, পোল্যাণ্ড, হাঙ্গেরি ইত্যাদি হিটলারের প্রভাবাধীন দেশসমূহের নীলস্ বোর, এনরিকো ফার্মি, ইউজিন ওয়াইগনার, হান, মাইটনার, স্ট্রাসমান ও আইনস্টাইন প্রভৃতি বহু খ্যাতনামা বিজ্ঞানী স্বদেশ ত্যাগ করিয়া যুক্তরাষ্ট্রে চলিয়া যান। যুক্তরাষ্ট্র সরকার নবাগত ইউরোপীয়ান বিজ্ঞানীগণকে সাদরে গ্রহণ করেন এবং আবশ্যকীয় অর্থ ও মাল-মশলা দ্বারা পারমাণবিক শক্তি উন্মোচনে তাহাদিগকে যথাযোগ্য সাহায্য করিতে থাকেন।
ইতালির বিজ্ঞানী ফার্মির পরিচালনায় তত্ৰত্য দেশী ও বিদেশী বিজ্ঞানীগণের আপ্রাণ চেষ্টার ফলে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেডিয়ামের একটি স্কোয়াশ কোর্টে ইউরেনিয়ামের পরমাণু ভাঙ্গিয়া পারমাণবিক শক্তি উৎপন্ন সাধ্যায়ত্ত হয় ১৯৪২ সালের ২ ডিসেম্বর।
পারমাণবিক শক্তি আবিষ্কৃত হইলে বিজ্ঞানীগণ মনোনিবেশ করেন পারমাণবিক বোমা তৈয়ার করিতে। আমেরিকার ওপি, ইতালির ফার্মি ও সেগ্রি, ডেনমার্কের নীলস বোর, বৃটিশ মিশনের নেতা শ্যাডউইক প্রমুখ বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানী ও তাহাদের সহকর্মীদের সমবেত গবেষণার ফলে অচিরেই তাঁহারা পারমাণবিক বোমা তৈয়ার করিতে সক্ষম হইলেন –নিউ মেক্সিকোর লস আলাম-এ।
পারমাণবিক বোমা তৈয়ার হইলে ১৯৪৫ সালের জুলাই মাসে উহার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটানো হয় লস আলামস হইতে দুইশত মাইল দূরে মেক্সিকোর আলমো গোর্ডো মরুবক্ষে। ট্রিনিটিতে। ইহাই দুনিয়ার সর্বপ্রথম পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ।
পারমাণবিক বোমার কার্যকর ব্যবহার হইল জাপানের নাগাসাকি ও হিরোশিমা নিবাসী হতভাগ্য মানুষদের প্রাণের উপর, আগস্ট ১৯৪৫-এ। শুধু মানুষই বা বলি কেন, বাদ গেল না পশু, পাখি, কীট-পতঙ্গ এবং জলজন্তুরাও। নিমেষে ধংস হইল অসংখ্য প্রাণী।
পারমাণবিক বিস্ফোরণের সময়ে যে সব তেজস্ক্রিয় রশ্মি বাহির হইয়া আসে, তাহা জীবদেহে। নানারূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই সম্বন্ধে জাপানের বিজ্ঞানী ডাক্তার মাসাও সুজুকি বলিয়াছেন, “আণবিক পরীক্ষাকার্য এখন বন্ধ করে দিলেও, যা বিস্ফোরণ এ পর্যন্ত হয়েছে, তার ফলেই ২৬ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৫০ হাজার লোক লিউকেমিয়া রোগের কবলে পতিত হবে।” তেজস্ক্রিয়, রশিমালা প্রথমত জীবদেহে ঢুকিয়া রক্তের শ্বেত কণিকার সংখ্যা বাড়াইয়া তোলে এবং লোহিত কণিকাগুলি নষ্ট করিয়া দেয়, ফলে রক্তশূন্যতাজনিত পূর্বোক্ত লিউকেমিয়া রোগ দেখা দেয় ও কোনো কোনো কোষ মারাও যায়। রুগ্ন কোষগুলির বংশবৃদ্ধির ফলে ক্যানসার বা কর্কট রোগ ও চক্ষুর ছানি রোগ দেখা দেয়।
আমরা জানি যে, জীবের জন্মমুহূর্তে থাকে একটি মাত্র জীবকোষ (জননকোষ) এবং তাহাতে ৪৬টি ক্রোমোসোম। এই ক্রোমোসোমে আবার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম একটি পদার্থ থাকে, যাহাকে বলা হয় জীন। এই জীনগুলিই হইল জীবের বংশগতির বৈশিষ্টের নিয়ামক। পারমাণবিক বিস্ফোরণের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ এই জীনগুলির বিশেষ ক্ষতি করে। কোনো স্ত্রীলোক বিকিরণাহত হইলে তাহার সন্তানোৎপাদিকাশক্তি রহিত হইয়া যায় বা কোনো কোনো অবস্থায় গর্ভপাত হয়, কোনো কোনো সময়ে পুরুষেরাও বন্ধ্যাত্ব লাভ করে।
আবার কোনো কোনো সময় তেজস্ক্রিয় রশ্মির ছোঁয়ায় জীনগুলির বিশেষ পরিবর্তন হয়। বিজ্ঞানী স্লেটিস-এর মতে, এই পরিবর্তন বংশানুক্রমে চলিতে থাকে এবং পরিবর্তিত জীনধারী দম্পতির জন্মে অপূর্ণ, অপরিণত ও স্বল্পায়ু সন্তান।
পরম সুখের বিষয় এই যে, বর্তমানে প্রায় সকল রাষ্ট্রই পারমাণবিক মহাশক্তিকে মানবকল্যাণে নিয়োজিত করার জন্য উঠিয়া-পড়িয়া লাগিয়াছে এবং বিজ্ঞানীগণ কৃষি, চিকিৎসাদি নানা ক্ষেত্রে ইহার ব্যাপক ব্যবহারের গবেষণা চালাইতেছেন। বিজ্ঞানীদের কাছে এখন আর অসম্ভব বলিয়া বেশি কিছু নাই। এই পারমাণবিক মহাশক্তির দ্বারা হয়তো একদিন সম্ভব হইবে মেরু অঞ্চলকে উত্তপ্ত এবং মরু অঞ্চলকে শীতল ও উর্বরা করিয়া উভয়ত প্রাণীবাসের সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করা, জীবকোষের স্বাভাবিক ক্ষয় রোধ বা পূরণ করিয়া জীবকে অমর বা দীর্ঘায়ু করা এবং অনুরূপ আরও অনেক কিছু; হয়তোবা প্রাণসৃষ্টিও।
পারমাণবিক শক্তি একটি মহাশক্তি। শত শত বিজ্ঞানী আজ ব্যস্ত রহিয়াছেন এই শক্তিসমুদ্র মন্থনে। সমুদ্রমন্থনের একটি পৌরাণিক আখ্যান মনে পড়িল। আখ্যানটি এইরূপ — মহর্ষি দুর্বাসার শাপে দেবরাজ ইন্দ্র শ্রীহীন হইলে লক্ষ্মী সমুদ্রগর্ভে গিয়া বাস করেন। তাহাতে ত্রিলোক শ্রীভ্রষ্ট হয়। পরে ব্রহ্মার উপদেশে দেবগণ মন্দার পর্বতকে মন্থনদণ্ড এবং বাসুকিকে মন্থনরঙ্কু করিয়া সমুদ্রকে মন্থন করিতে থাকেন। এইরূপ মথিত হইলে সমুদ্র হইতে লক্ষ্মী, চন্দ্র, পারিজাত, ধন্বন্তরী, ঐরাবত হস্তী, উচ্চৈশ্রবাঃ অশ্ব প্রভৃতি ও অমৃত উত্থিত হয়। দেবতারা উহা ভাগ করিয়া লন ও অমৃত পান করিয়া অমর হন।