উক্ত সূত্র কয়টি অবলম্বনে গ্রাম সাহেব একটি বিদ্যুৎ উৎপাদক যন্ত্র তৈয়ার করিলেন। ঘোড়ার পায়ের নালের মতো একটি বাঁকানো কোমল লোহার গায়ে তামার তার জড়াইয়া উহাতে ক্ষীণ বিদ্যুৎ প্রবাহ চালানো হইলে লৌহটি চুম্বকে পরিণত হইল। অতঃপর বাঁকানো চুম্বকটির মাঝখানে অর্থাৎ চুম্বকের বলক্ষেত্রে বহুপ্যাঁচবিশিষ্ট একটি বেষ্টনী (আর্মেচার) দ্রুত ঘুরাইতে থাকিলে উহাতে খুব শক্তিশালী বিদ্যুৎ উৎপন্ন হইল। রাসায়নিক বিদ্যুৎ ততক্ষণই পাওয়া যায়, যতক্ষণ পর্যন্ত কোষে রাসায়নিক ক্রিয়া অব্যাহত থাকে, অতঃপর বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হইয়া যায়। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত চুম্বকের বলক্ষেত্রে আর্মেচার ঘুরানো যায়, ততক্ষণ ডাইনামো যন্ত্রে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হইতে থাকে এবং উহা পরিমাণেও হয় কোষের বিদ্যুতের চেয়ে বহুগুণ বেশি। তাই বর্তমানে সব দেশেই ডাইনামো যন্ত্রের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হইতেছে। মূলত সকল ডাইনামো যন্ত্রই গ্রামের উদ্ভাবিত ডাইনামো যন্ত্রের উন্নত সংস্করণ মাত্র।
বিদ্যুৎশক্তির দ্বারা বর্তমান দুনিয়ায় বহু অসাধ্য সাধন করা হইতেছে। টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, রেডিও, টেলিভিশন, বাতি, পাখা, মোটর, ট্রাম, এক্সরে ইত্যাদি হইতে শুরু করিয়া রান্না-বান্না, এমনকি ঘর ঝাট দেওয়া পর্যন্ত অসংখ্য কাজ বিদ্যুৎশক্তির দ্বারা সম্পন্ন করা হইতেছে। বর্তমান জগতের যাবতীয় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মধ্যে বিদ্যুতের ক্ষেত্র সুবিশাল। বিশেষত বিদ্যুৎভিত্তিক যাবতীয় আবিষ্কারগুলিই অতিশয় আশ্চর্যজনক, বলিতে হয় অলৌকিক। বিদ্যুৎশক্তি মানুষকে পৌঁছাইয়া দিয়াছে এক যাদুর রাজ্যে।
.
# পারমাণবিক শক্তি
মানুষ আজ পর্যন্ত প্রকৃতির গর্ভে যত রকম শক্তির সন্ধান পাইয়াছে, তন্মধ্যে পারমাণবিক শক্তি অতুলনীয়। ইহা মানবকল্যাণের অসংখ্য সম্ভাবনায় ভরপুর। সামান্য কয়েক বৎসরের মধ্যে বহুবিধ জনহিতকর কাজে ইহার ব্যবহার শুরু হইয়াছে এবং এই শক্তিটির সাহায্যে মানুষের গ্রহান্তরে গমনের সম্ভাবনা দেখা দিয়াছে। কিন্তু নাগাসাকি ও হিরোশিমার ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটিবার নিশ্চয়তাবিধান এখনও হয় নাই। আজও কোনো কোনো দেশের ভূগর্ভে বা সাগরবুকে পারমাণবিক বোমা ফাটার শব্দ কানে আসিতেছে। শান্তিবাদীরা ইহাকে যেমন সৃজনাত্মক কাজে ব্যবহারের জন্য প্রকাশ্যে চেষ্টা চালাইতেছেন, তেমন সাম্রাজ্যবাদীরা ইহার ধংসাত্মক শক্তির উৎকর্ষ সাধনের জন্য গবেষণা চালাইতেছেন গোপনে।
পারমাণবিক শক্তিটির প্রথম সাক্ষাত মেলে পরম বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের বিখ্যাত আপেক্ষিক। তত্ত্বের মাধ্যমে (১৯০৫)। তিনি বলিলেন যে, শক্তির সংহতিতে হয় জড়ের উৎপত্তি এবং জড়ের ধংসে হয় শক্তির উদ্ভব। অর্থাৎ পদার্থ ও তাহার অন্তর্নিহিত শক্তি আসলে একই জিনিষ। তিনি সূত্র করিলেন –E = Mc2।
আমরা জানি যে, ইলেকট্রন-প্রোটনাদি শক্তিকণিকার সংখ্যার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন জাতীয় পরমাণু তথা মৌলিক পদার্থের রূপায়ণ। শক্তিকণিকাগুলির প্রত্যেকের স্বকীয় ভর বা ওজন আছে। তাই শক্তিকণিকাগুলির সংখ্যানুপাতে নির্দিষ্ট হয় পরমাণুর ওজন। একটি হাইড্রোজেন পরমাণুতে থাকে ১টি ইলেকট্রন ও ১টি প্রোটন এবং উহার আণবিক ওজন হয় ১.০০৮১৩।[৩৩] হাইড্রোজেনের এই আণবিক ওজনের অর্থ হইল এক জোড়া ইলেকট্রন-প্রোটনের ওজন। একটি হিলিয়ামের পরমাণুতে থাকে ২টি ইলেকট্রন, ২টি প্রোটন ও ২টি নিউট্রন; ইহার আণবিক ওজন হওয়া উচিত ৪.০৩৪১৮। কিন্তু দেখা গেল যে, তাহা না হইয়া একটি হিলিয়াম পরমাণুর ওজন পাওয়া যায় ৪.০০৩৮৪, অর্থাৎ সামান্য কিছু কম। ইহার কারণ কি? এই প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর কোনো বিজ্ঞানী তখন দিতে পারিলেন না।
বিজ্ঞানীপ্রবর আইনস্টাইন বলিলেন যে, ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন লইয়া হিলিয়াম পরমাণু যখন প্রথম গঠিত হয়, তখন একটুখানি পদার্থ বিনষ্ট হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে বহু পরিমাণ শক্তি বাহির হইয়া যায়। আইনস্টাইনের অঙ্কের হিসাবে দাঁড়াইল— একটি হিলিয়াম পরমাণুর উৎপত্তির জন্য পদার্থের বিলোপে যে শক্তির উদ্ভব হয়, তাহা তিন কোটি বিভবের (potential) তড়িৎ দ্বারা চালিত একটি ইলেকট্রনের শক্তির সমান। এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী এডিংটন বলেন যে, সূর্যের অভ্যন্তরস্থ সমস্ত হাইড্রোজেনের শতকরা দশভাগ যদি হিলিয়ামে রূপান্তরিত হয়, তবে তাহাতে যে শক্তির উদ্ভব হইবে, তাহা সূর্যের বর্তমান তেজকে বজায় রাখিতে পারিবে ১০০ কোটি বৎসর।
ঐ সম্পর্কে বিজ্ঞানী অ্যাস্টন বলিয়াছেন, “ভবিষ্যতে কোনো গবেষক যদি পদার্থের অন্তর্নিহিত শক্তিকে এইরূপভাবে মুক্ত করিতে পারেন, যাহাতে উহা মানুষের কাজে আসিতে পারে, তবে মনুষ্য জাতি যে প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী হইবে, তাহা বিজ্ঞানের কল্পনার অতীত। এই শক্তি মুক্ত হইলে, হয়তো উহা মানুষের আয়ত্তের বাহিরে চলিয়া যাইবে এবং উহার প্রচণ্ডতা হয়তো নিকটবর্তী যাহা কিছু আছে, সব ধ্বংস করিবে। এইরূপে হয়তো পৃথিবীর সমস্ত হাইড্রোজেন মুহূর্তের মধ্যে রূপান্তরিত হইয়া শক্তিতে পরিণত হইবে এবং তাহা হইলে এই পরীক্ষার সাফল্যে আমাদের পৃথিবী হয়তো ব্রহ্মাণ্ডের একটি নূতন নক্ষত্ররূপে প্রকাশিত হইবে।”