.
# বৈদ্যুতিক শক্তি
সেকালের মানুষের ধারণা ছিল যে, বিদ্যুৎ একটি স্বর্গীয় পদার্থ এবং উহা ব্যবহার করেন দেবতা বা ফেরেশতারা। বিদ্যুৎচমক বা বজ্রপাত সম্বন্ধে মুসলমানগণ বলেন যে, উহা শয়তানের প্রতি ফেরেশতাগণের তীরনিক্ষেপ এবং ‘লা হাওলা অলাকুওয়াতা ইল্লাবিল্লাহিল আলিওল আজিম’ –এই বাক্যটি উচ্চারিত হইলে সেখানে বজ্রপাত হয় না। পক্ষান্তরে হিন্দুগণ বলিয়া থাকেন যে, দধীচি মুনির অস্থি দ্বারা বজ্রবাণ তৈয়ারী এবং উহা ব্যবহার করেন দেবরাজ ইন্দ্র, তাহার– শত্ৰুনিপাতের জন্য; ‘জৈমিনিশ্চ সুমন্তু বৈশম্পায়ন এব চ। পুলস্ত্যঃ পুলহো জিফ ষড়েতে বজ্ৰবারকা’ –এই মন্ত্রটি উচ্চারিত হইলে সেখানে বজ্রপাত হয় না। সে যাহা হউক, দেবতাদি বোধ হয় কালসমুদ্রে ডুবিয়া মরিয়াছেন; বর্তমানে বিদ্যুতের স্বত্বাধিকারী হইয়াছে একমাত্র মানুষ।
কাঁচে রেশম ঘষিলে উহাতে যে বিদ্যুৎ জন্মে এবং তাহা যে হাল্কা জিনিষকে আকর্ষণ করে, ইহা অনেকদিন আগে লোকে জানিত। কিন্তু জলপ্রবাহের মতো বিদ্যুতেরও যে প্রবাহ আছে, তাহা বিজ্ঞানীরা জানিয়াছেন মাত্র অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে।
১৭৮৬ খ্রীস্টাব্দে একদিন গ্যালভনি নামক ইতালির একজন বিজ্ঞানী একটি ব্যাঙ মারিয়া তাহার পেশী-স্নায়ু পরীক্ষা করিতেছিলেন। মরা ব্যাঙটি তামার আংটায় ঝুলানো ছিল এবং কাছেই লোহার গরাদ ছিল। হঠাৎ এক আশ্চর্য ঘটনা দেখা গেল। মরা ব্যাঙের দেহ যেমনই গরাদের গায়ে ঠেকিতে লাগিল, অমনি সেইটি জীবিত ব্যাঙের মতো পা ছুঁড়িতে লাগিল। গ্যালভনি তো অবাক। তিনি ভাবিলেন যে, প্রাণীর শরীরে এক রকম বিদ্যুৎ আছে। ধাতু যখন ব্যাঙের দুই অংশে সংযুক্ত করা হইল, তখন সেই বিদ্যুতই তাহার পা সঙ্কুচিত করিল। এই ঘটনা প্রকাশে দেশে বিদেশে মহা হুলস্থূল পড়িয়া গেল।
এই সময় ভল্টা নামে একজন মহাজ্ঞানী লোক ছিলেন ইতালিতে। তিনি ঐ বিষয়ে পরীক্ষা করিয়া বলিলেন যে, শরীরের বিদ্যুৎ মরা ব্যাঙের পা সঙ্কুচিত করে নাই, উহার গায়ে যে তামা ও লোহা ঘেঁয়ানো ছিল, তাহাই বিদ্যুৎ উৎপন্ন করিয়াছিল এবং সেই বিদ্যুতই মরা ব্যাঙের পা টানিয়া ধরিয়াছিল। দুই রকম ধাতুকে একত্রে ছোঁয়াইলে যে মরা ব্যাঙ পা ছেড়ে, ভলটা তাহা সকলকে প্রত্যক্ষ দেখাইতে লাগিলেন। অতঃপর তিনি ব্যাঙকে বাদ দিয়া দুইটি পৃথক ধাতুকে গায়ে গায়ে লাগাইলেন এবং তাহার মধ্যে একটি ধাতু যে ধনবিদ্যুতে (Positive Electricity)। এবং অন্যটি ঋণবিদ্যুতে (Negative Electricity) পূর্ণ হইল, তাহা সকলকে দেখাইলেন।
ভলটা তামা ও দস্তা, এই দুইটি পৃথক ধাতুর কতগুলি চাকতি তৈয়ার করিয়া, তামার উপরে দস্তা ও তাহার উপরে তামা পরে পরে সাজাইয়া একটি যন্ত্র নির্মাণ করিলেন এবং তামা ও দস্তার চাকতির মাঝখানে সালফিউরিক অ্যাসিডে ভিজানো ন্যাকড়া রাখিয়া দিলেন। ইহাতে দেখা গেল যে, উপরকার দস্তায় ঋণবিদ্যুৎ এবং সকলের নিচেকার তামায় ধনবিদ্যুৎ জমিয়াছে। তাহার পর। সব তলাকার তামার চাকতির সঙ্গে উপরকার দস্তার চাকতিকে তার দিয়া সংযুক্ত করায় ঐ তার দিয়া বিদ্যুৎ প্রবাহ চলিতে লাগিল। এই যন্ত্রটিকে বলা হয় ‘ভলটার পাইল’।
গ্যালভনির সূচনায় ভলটা তামা, দস্তা ও সালফিউরিক অ্যাসিডের সাহায্যে যে ক্ষীণ বিদ্যুৎ প্রবাহের পরিচয় পাইয়াছিলেন, বর্তমান কালের সব রকম বিদ্যুৎ উৎপাদক কোষ (Battery Cell) তাহারই উপর প্রতিষ্ঠিত। সব রকম বিদ্যুৎ কোষেই থাকে পৃথক দুইটি জিনিষের ফলক এবং একটি সংযোজক বস্তু, আর বাহিরে থাকে ঐ ফলক দুইটিকে সংযুক্ত করিয়া তামা প্রভৃতি ধাতুর তার বা অন্য কিছু। তবে পরে শত শত বিজ্ঞানী নানা চেষ্টায় বিদ্যুতের ক্ষীণ প্রবাহকে প্রবল করিয়া তুলিয়াছেন এবং তদ্বারা মানুষকে ভেল্কিবাজি দেখাইতেছেন। ভলটার নামানুসারে বিদ্যুৎ প্রবাহের বলকে বলা হয় ভোল্ট।
অধুনা বিদ্যুৎ উৎপাদন করিবার পদ্ধতি দুইটি –রাসায়নিক ও যান্ত্রিক। ভলটার কোষে উৎপাদিত বিদ্যুৎকে বলা হয় রাসায়নিক বিদ্যুৎ। ইহাতে বিদ্যুতের পরিমাণ এবং প্রবাহক বল খুব বেশি হয় না। তাই উহা দ্বারা বর্তমান সময়ের ঢাকা, কলিকাতা ইত্যাদির মতো বড় বড় শহরের বিদ্যুতের চাহিদা মিটানো যায় না। উহার জন্য আবশ্যক হয় যান্ত্রিক বিদ্যুৎ। যে যন্ত্রের সাহায্যে যথেচ্ছ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব, তাহার নাম ডাইনামো। একটি সাধারণ ডাইনামো যন্ত্রে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ পাওয়া যায়, হাজার হাজার কোষ সাজাইয়াও তাহা পাওয়া সম্ভব নহে। এই যন্ত্রটি আবিষ্কার করিলেন লিগ শহরের ‘গ্রাম’ নামক একজন বিজ্ঞানী, মাত্র কয়েক বৎসর আগে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের কৌশল জানার পর বিজ্ঞানী মহলে উহা লইয়া নানারূপ গবেষণা চলিতে থাকে এবং কয়েকটি সূত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীগণ জানিতে পারিলেন যে, কোমল লৌহদণ্ডের উপর তার জড়াইয়া ঐ তারে বিদ্যুৎ চালাইলে লৌহদণ্ডটি চুম্বকত্বপ্রাপ্ত হয়। যে কোনোও চুম্বকের উত্তর ও দক্ষিণ মেরুকে সংযুক্ত করিয়া কতগুলি চৌম্বক বলরেখা বিদ্যমান থাকে। চুম্বকের বলরেখার মধ্যে রাখিয়া কোনো ধাতব তারের বেষ্টনী (কয়েল বা আর্মেচার) নাড়াচাড়া করিলে উহাতে বিদ্যুতের আবেশ হয় (উহাকে আবিষ্ট বিদ্যুৎ বলে)। পরীক্ষায় ইহাও প্রমাণিত হইল যে, চুম্বকের শক্তি ও বেষ্টনীর তারের প্যাঁচের সংখ্যা যতই বাড়ানো যায় এবং বেষ্টনীকে যত দ্রুত ঘুরানো যায়, বিদ্যুতের পরিমাণ ততই বৃদ্ধি পায়।