ধর্মগুরুরা শাসক ছিলেন না, ছিলেন উপদেশক। কেননা আদিতে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল না, ছিল পুরোহিততন্ত্র। মধ্যযুগে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইলে, যখন দেখা গেল যে, শুধু নীতিবাক্য আওড়াইয়া এবং পাপ আর নরকের ভয় দেখাইয়া মানুষকে সৎপথে রাখা যায় না, তখন ধর্মগুরুদের পিছনে রাখিয়া সম্মুখে দাঁড়াইলেন রাষ্ট্রপতিরা; পাপকে অপরাধ আখ্যা দিয়া পরকালের শাস্তির পূর্বেই তাহারা শুরু করিলেন অর্থদণ্ড, কারাদণ্ড, হস্তচ্ছেদন, চাবুকাঘাত ইত্যাদি আশু শাস্তির ব্যবস্থা। আবার বর্তমান যুগে ধর্মীয় নীতির তালিকাভুক্ত প্রায় সমস্ত নীতিই হইয়াছে রাষ্ট্রনীতির তালিকাভুক্ত এবং স্বর্গ বা নরকবাসের পূর্বে হইয়াছে দণ্ড ও পুরস্কারের বিধান।
অধুনা আন্তর্জাতিক নীতিতে কতক ধর্মীয় নীতি পড়িয়াছে বাতিলের পর্যায়ে। যেমন –অবরোধ প্রথা, চিত্রাঙ্কন, গান-বাজনা, খেলাধুলা, কুসীদ গ্রহণ, মদনমিরাস ইত্যাদি বিষয়ক নীতিসমূহ।
ধর্মীয় শিক্ষার ফলে আদিম মানবদের লাভ হইয়াছে যথেষ্ট। এবং বর্তমান যুগেও উহার আবশ্যকতা ফুরায় নাই।
.
আধুনিক সভ্যতা
বর্তমান যুগটিকে বলা হয় বিজ্ঞানের যুগ এবং যন্ত্রযুগও। বিজ্ঞানের যুগ বলা হয় এই জন্য যে, পূর্বে যে কোনো তত্ত্ব নির্ণয় করিতেন সেকালের তত্ত্বজ্ঞানীরা নিজেদের অনুমান ও কল্পনার সাহায্যে এবং উহা জনসমাজে গৃহীত হইত বিশ্বাসের ভিত্তিতে। কেননা তখন পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ রীতি ছিল না। আর বর্তমান যুগে কোনো তত্ত্বই তত্ত্ব বলিয়া গৃহীত হয় না, পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ ছাড়া। এই পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণই হইল বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি। আজ ভূতত্ত্ব, আকাশতত্ত্ব, রসায়নতত্ত্ব, শরীরতত্ত্ব, প্রাণতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি সমস্ত তত্ত্বই নির্ণীত হইয়া থাকে পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ রীতিতে, অর্থাৎ জ্ঞানের ভিত্তিতে। গান, বাজনা, চিত্র ইত্যাদি শিল্পকলা এমনকি সমাজ বা রাষ্ট্রবিধানও আজ বিজ্ঞানভিত্তিক। তাই এই যুগটিকেই বলা হয় বিজ্ঞানের যুগ।
এই যুগের মানুষ কোনো কাজই শুধু গায়ের জোরে করিতে চাহে না, চাহে কৌশলে অর্থাৎ যন্ত্রের সাহায্যে করিতে। নানাবিধ কাজ অতি সহজে সম্পন্ন করিবার জন্য অধুনা এত অধিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হইয়াছে যে, সেই সবের নাম জানা বা সংখ্যা নির্ণয় করাই মুশকিল। এই জন্য এই যুগটিকে বলা হয় যন্ত্রযুগ।
আজকাল যন্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে হাজার হাজার রকম এবং প্রতিটি আবিষ্কারই মানব সভ্যতাকে কিছু না কিছু আগাইয়া দিয়াছে সম্মুখের দিকে। কিন্তু সকল রকম আবিষ্কার বা যন্ত্রের মূলে রহিয়াছে তিনটি প্রধান আবিষ্কার। যথা –বাষ্পীয়, বৈদ্যুতিক ও পারমাণবিক শক্তি।
.
# বাষ্পীয় শক্তি
প্রকৃতপক্ষে আধুনিক সভ্যতার প্রধান উৎস বাষ্পীয় শক্তির আবিষ্কার। এই শক্তিটি আবিষ্কারের পূর্বে যে সকল মামুলি ধরণের যন্ত্র বানানো হইত, তাহা চালানো হইত মানুষ বা পশুর শক্তিতে এবং তাহাতে কাজ পাওয়া যাইত সামান্য। তখনও কোনো কোনো দেশে রেল বসানো রাস্তা ছিল, কিন্তু উহাতে মালগাড়ি চলিত গাধার সাহায্যে এবং ঘোড়ার সাহায্যে চলিত ডাকগাড়ি।
একটি প্রবাদ আছে যে, জেমস্ ওয়াট একদা একটি কেতলির ফুটন্ত পানি হইতে বাষ্প নির্গত হওয়ার দৃশ্য দেখিয়া বাষ্পীয় শক্তির সন্ধান পান। সুতরাং বাষ্পীয় শক্তির আবিষ্কারক তিনিই। বস্তুত মানুষ বাষ্পীয় শক্তির সন্ধান পাইয়াছিল ইহার অনেক আগেই এবং বাষ্পীয় ইঞ্জিনও তৈয়ার হইয়াছিল ওয়াটের আগে। তবে উহা তেমন কার্যকর ছিল না এবং উহার ব্যবহার হইত শুধু কয়লার খনিতে।
জেমস ওয়াটের স্টিম ইঞ্জিন তৈয়ারের প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে ডার্টমাউথ নিবাসী নিউকোমেন একটি স্টিম ইঞ্জিন নির্মাণ করিয়াছিলেন। এইটিও ব্যবহৃত হইত কয়লা উত্তোলনের কাজে। তবু বিংশ শতকের প্রথম দিকেই বাষ্পচালিত এইরূপ টারবাইন নির্মাণ করা হইয়াছিল, যাহার এক একটির সাহায্যে ৪৩,৭০০টি অশ্বের শক্তির সমান কাজ করা সম্ভব ছিল।
যদিও ওয়াট বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের আবিষ্কর্তা নহেন, তবুও তাহাকে বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের ‘জনক’ বলা হয়। বস্তুত ফুটন্ত পানি হইতে উৎপন্ন বাষ্পকে জগদ্ব্যাপী মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করার উন্নততর পদ্ধতি প্রথমে তিনিই দেখাইয়াছেন। জলযানে স্থাপিত হইল বাষ্পীয় ইঞ্জিন এবং জর্জ স্টিফেনসন নির্মাণ করিলেন বাষ্পীয় রেল ইঞ্জিন। বিভিন্ন বিজ্ঞানীর গবেষণার ফলে বাষ্পীয় ইঞ্জিন হইল উন্নত হইতে উন্নততর এবং উহা ব্যবহৃত হইতে লাগিল জলে ও স্থলে, বিবিধ শিল্প প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনে। পূর্বে যেখানে ছিল পশুচালিত গাড়ি ও দাঁড়-পালের নৌকা, যাহার গতিবেগ ঘণ্টায় ৭-৮ মাইলের বেশি ছিল না, এখন সেখানে চলিতেছে রেলগাড়ি ও ইঞ্জিনচালিত জাহাজ, যাহার গতিবেগ ঘণ্টায় ক্ষেত্রবিশেষে একশ’ মাইলেরও বেশি। উহাতে যেমন বৃদ্ধি পাইয়াছে পরিবহন ক্ষমতা, তেমনি হ্রাস পাইয়াছে সময়ের অপব্যয়।
বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের ফলে পরম উৎকর্ষ দেখা দিয়াছে শিল্পক্ষেত্রে। ইহাতে যেমন বৃদ্ধি পাইয়াছে বিবিধ শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদন, তেমনই বৃদ্ধি পাইয়াছে আমদানি ও রপ্তানি দ্রব্যের পরিমাণ। সুলভ ও সহজলভ্য হইয়াছে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। ফলত, মানুষের সমাজজীবনোন্নয়নের মস্তবড় একটি সোপান হইল বাষ্পীয় শক্তির ব্যবহার।