সেকালের চিত্রলিপির পাত্র ছিল সাধারণত গুহাপ্রাচীর, পর্বতগাত্র ইত্যাদি এবং অক্ষরলিপির পাত্র ছিল মৃৎচাকতি, শিলাখণ্ড, পশুচর্ম, ধাতুপাত, বৃক্ষপত্র ইত্যাদি। এইদেশে তাল, কদলী, ভূর্জ ইত্যাদি বৃক্ষপত্রে লিখন প্রচলিত ছিল কিছুদিন আগেও এবং চিঠি বা পুস্তকাদি লিখা হইত উহাতেই। তাই এখনও আমরা চিঠিকে পত্র এবং বইয়ের পৃষ্ঠাকে পাতা বলিয়া থাকি।
খননকার্যের ফলে পাঁচ-ছয় হাজার বৎসর পূর্বের কঁচা বা পোড়ামাটির চাকতির বহু লিপি আবিস্কৃত হইয়াছে। বারোখানা চাকতির উপর লিখিত তিনশত পঙক্তি সমন্বিত গিলগামেশ নামক একখানা মহাকাব্য উদ্ধার করা হইয়াছে, তাহার কতক পাওয়া গিয়াছে নিনেভ-এ আসুরবানিপাল এর গ্রন্থালয়ের ভগ্নস্তূপের মধ্যে। খ্রী. পূ. তিন হাজার বৎসর আগে প্যালেস্টাইনে লিখন প্রচলিত ছিল, তাহার প্রমাণ আছে। ঐখানে শতাধিক শিলালিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে।
আরবের মজা সমুদ্রের উত্তর-পূর্ব দিকে কোনো পাহাড়ের গুহায় ১৯৪৭ সালে পাওয়া গিয়াছিল কতগুলি মাটির জালার সারি, উহা সরা দিয়া ঢাকা। সরা উঠাইয়া দেখা গেল যে, জালাগুলিতে মেষচর্মের তাড়া ভর্তি এবং তাহার উপর আলকাতরার মতো কালো কালিতে হিব্রু অক্ষরে লেখা প্রাচীন বিধান বাইবেলের কতিপয় অংশ। উহাতে রহিয়াছে খ্রী. পূ. ২২৫ অব্দে লিখিত ‘স্যামুয়েল’! গ্রন্থের নানান অংশ এবং খ্রী. পূ. ১০০ অব্দে লিখিত সম্পূর্ণ ‘ইসায়া’ গ্রন্থ। ঐগুলিকে বলা হয় ডেড সি স্ক্রোল। স্ক্রোলগুলির মধ্যে যীশুখ্রীস্টের নিজের ভাষা আরামাইক-এ লিখিত গ্রন্থও আছে।
আদিম মানবেরা মাটি, পাথর, গাছের পাতা, পশুর চামড়া ইত্যাদিতেই লিখিত। কিন্তু মিশরীয়রা কালি, কলম ও কাগজ আবিষ্কার করিয়াছিল। উদ্ভিদের আঠার সঙ্গে হাঁড়ির গায়ের কালো স্কুল গুলিয়া, সেই গাঢ় তরল পদার্থকে আগুনে জ্বাল দিয়া কালি প্রস্তুত করা হইত এবং খাগের কলম ব্যবহৃত হইত। প্যাপিরাস নামক নলখাগড়া জাতীয় কোনো জলজ উদ্ভিদকে থেঁতো করিয়া মণ্ড তৈয়ার করা হইত এবং উহাকে বিস্তার করিয়া রৌদ্রে শুকাইয়া মসৃণ, শক্ত, হলুদ রঙের কাগজ প্রস্তুত করা হইত। এইরূপে প্রস্তুত হইয়াছিল প্রথম কাগজ। মিশরীয় জলজ উদ্ভিদ প্যাপিরাস হইতেই কাগজের ইংরাজি নাম হইয়াছে ‘পেপার’। কেহ কেহ বলেন যে, সর্বাগ্রে কাগজ প্রস্তুত হইয়াছিল চীন দেশে।
.
# ধর্ম
আদিতে মানুষের মন ছিল পশু-পাখিদের মনের মতোই সরল ও স্বাধীন। তখন মানুষ তাহার যে। কোনো ইচ্ছা বা প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করিতে পারিত ও করিত। জ্ঞানোন্মেষের সাথে সাথে মানুষ। প্রথমে দলবদ্ধ ও পরে সমাজবদ্ধ হইয়া বসবাস করিতে শুরু করিলে, এই দল ও সমাজকে রক্ষা করিতে আবশ্যক হইল ত্যাগ ও সংযমের। আদিতে এই ত্যাগ ও সংযম ছিল স্বেচ্ছাধীন। ক্রমে যখন সভ্যতা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল, তখন তাহার দল বা সমাজের বন্ধন দৃঢ় করার জন্য সংযমকে বাধা হইল নীতি ও নিয়মের শৃঙ্খলে। ইহাতে মানুষের সেই স্বাধীন প্রবৃত্তিগুলিকে সু ও কু– এই দুই ভাগে বিভক্ত করিয়া সু প্রবৃত্তিগুলিকে স্বাধীনই রাখা হইল এবং কু প্রবৃত্তিগুলিকে করা হইল বন্দী। এই সু ও কু অর্থাৎ সৎ ও অসৎ কার্যবিভাগ করিয়াছিলেন বোধহয় সেকালের অঞ্চলবিশেষের গোষ্ঠীপতি বা সমাজপতিরা। আর ইহাই ছিল সম্ভবত মানুষের সমাজজীবন উন্নয়নের প্রাথমিক ধাপ।
কালক্রমে মানুষের জ্ঞানবৃদ্ধির সাথে সাথে তৎকালীন বিশিষ্ট জ্ঞানীগণ যখন বিশ্ব-প্রকৃতি সম্বন্ধে ভাবিতে শুরু করিয়াছিলেন এবং চিন্তা করিতেছিলেন মানবজীবনের অতীত ও ভবিষ্যত সম্বন্ধে, তখন হইতে তাঁহাদের মনে জাগিতেছিল দৈবশক্তি বা ঈশ্বর ও পরকাল সম্বন্ধে নানা কথা। এই ঈশ্বর ও পরকাল সম্বন্ধে যাহাদের দৃঢ় প্রত্যয় জন্মিয়াছিল এবং জনগণের মধ্যে উহার বিশদ ব্যাখ্যা প্রচার করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন, তাঁহারাই ছিলেন সেকালের ধর্মগুরু, যেমন –বৈদিক ঋষিগণ, জোরওয়াস্টার, বুদ্ধ প্রভৃতি। ধর্মগুরুরা সংখ্যায় ছিলেন অনেক এবং দেশ ও কালভেদে উঁহাদের সকলের মতামতও এক ছিল না। তবে বুদ্ধাদি দুই-একজন ধর্মগুরু ভিন্ন জগতের প্রায় সকল ধর্মগুরুই দেবতা বা ঈশ্বর ও পরকালে বিশ্বাসী, পার্থক্য মাত্র ঈশ্বরের সংখ্যায়। কেহ বলিয়াছেন, ঈশ্বর এক এবং কেহ বলিয়াছেন, অনেক।
ধর্মগুরুরা নীতিবাক্য প্রচার করিয়াছেন অজস্র। আর উহাতে কাজও হইয়াছে ১৯৮৮ যথেষ্ট। অসংখ্য নর-নারী অসৎকাজ ত্যাগ করিয়া সৎকাজে ব্রতী হইয়াছেন ধর্মগুরুদের কথিত স্বর্গসুখের প্রত্যাশা ও নরকজ্বালার ভয়ে। মূলত পশুবৃত্তি বা স্বেচ্ছাচারিতা ত্যাগ করাইয়া মানুষকে সুসভ্য করিয়া গড়িয়া তুলিবার ব্যাপারে
ধর্মগুরু বনাম ধর্মের দান অপরিসীম। ধর্ম মানুষকে করিয়াছে নীতিপরায়ণ। শিক্ষানীতি, স্বাস্থ্যনীতি, খাদ্যনীতি, অর্থনীতি, যুদ্ধনীতি, শাসননীতি ইত্যাদি এমন কোনো নীতি নাই, যাহা ধর্মগুরুরা প্রচার করেন নাই। জন্মনীতি, মৃত্যুনীতি, যৌননীতি, বাহ্য-প্রস্রাব, এমনকি জলশৌচ করারও নীতি প্রচারিত হইয়াছে; তবে এককালে ঐ সবের আবশ্যকও ছিল।
ধর্মীয় নীতি বা নিষেধাজ্ঞাসমূহের অনেকগুলি যুগোপযোগী হইলেও উহার যাবতীয় বিধি নিষেধকে প্রচার করা হইয়াছে চিরস্থায়ী বলিয়া। কিন্তু যুগ বদলের সঙ্গে সঙ্গে আবশ্যক হইয়াছিল উহার কিছু কিছু সংশোধনের এবং সংশোধন শুরু হইয়াছিল মধ্যযুগেই।