.
# চাকা
কোনো ভারি পদার্থ উত্তোলন করিয়া লওয়া অপেক্ষা টানিয়া লওয়া সহজ এবং পদার্থটি গোল হইলে উহাকে গড়াইয়া লওয়া আরও সহজ। গোল পদার্থ গড়াইবার সহজ পদ্ধতিটি লক্ষ্য করিয়াই সেকালের মানুষ করিয়াছিল চাকা আবিষ্কার এবং তাহা হইতে হইয়াছিল টানাগাড়ি, ঠেলাগাড়ি ইত্যাদি মানুষ চালিত গাড়ির সৃষ্টি। চাকা আবিষ্কারের বহু আগেই মানুষ লাঙ্গল টানিবার কাজে পশু ব্যবহার করিতে শিখিয়াছিল। কাজেই মানুষচালিত গাড়িকে পশুচালিত গাড়িতে রূপায়িত করিতে বেশিদিন লাগে নাই। সেকালের গাড়ির উন্নত সংস্করণ ছিল রথ। উহা দুই বা চারি চাকা বিশিষ্ট অশ্বচালিত গাড়ি। সেকালের রাজ্যপালেরা উহা ব্যবহার করিতেন আনন্দবিহার এবং যুদ্ধের কাজে।
খ্রী. পূ. ১২৮৫ সালে ফেরাউন দ্বিতীয় রেমেসিস হজরত মূসার পশ্চাদ্ধাবন করিয়াছিলেন। রথে চড়িয়া (যাত্রাপুস্তক ১৪; ২৩, ২৫)। ইহাতে জানা যায় যে, তিন হাজার বৎসরের অনেক আগেও চাকাওয়ালা গাড়ির প্রচলন ছিল। গাড়ি আবিষ্কারের ফলে লোক চলাচল ও ব্যবসা বাণিজ্যের প্রভূত উন্নতি সাধিত হইয়াছিল।
আদিম মানবেরা যখন হইতে কঁচা মাছ-মাংস ভোজন ত্যাগ করিয়া রান্নাবান্না আরম্ভ করিয়াছে, তখন হইতেই শুরু হইয়াছে মৃৎপাত্র তৈয়ার ও উহার উন্নতির প্রচেষ্টা। কিন্তু চেষ্টা যতই হইয়া থাকুক, উহা সর্বাঙ্গসুন্দর হইতে পারে নাই চাকা আবিষ্কারের পূর্বে।
শুধু হাতে পিটিয়া-টিপিয়া মাটির পাত্র তৈয়ার করিতে গেলে উহা বাকাচোরা ও এবড়োখেবড়ো হওয়াই স্বাভাবিক। তখনকার যে সকল শিল্পীরা চাকা নির্মাণ ও উহার গবেষণার কাজে লিপ্ত ছিলেন, তাঁহারা লক্ষ্য করিয়াছিলেন যে, কোনো চাকার কেন্দ্রবিন্দুতে একটি শলাকা প্রবেশ করাইয়া উহাকে ঘুরাইয়া ছাড়িয়া দিলে, সে অনেক সময় ধরিয়া ঘুরিতে থাকে; তখন উহার ঐ ঘূর্ণায়মান গতি ও শক্তিকে লক্ষ্য করিয়াই শিল্পীরা করিয়াছিলেন কুমারের চাকা আবিষ্কার। আর ইহার ফলে হইয়াছিল মৃৎশিল্পের অভাবনীয় উন্নতি। সভ্যতা বিকাশের একটি বিশেষ ধাপ হইল চাকার আবিষ্কার। অধুনা বাস, ট্রাক, ট্রেন ইত্যাদি শত শত রকম স্থলযান বা গাড়ি উদ্ভাবন করা হইয়াছে এবং উহাতে কল-কৰ্জাও সন্নিবেশিত হইয়াছে নূতন নূতন, কিন্তু ইহার চাকাটি হইল প্রায় তিন হাজার বৎসরের পুরাতন।
.
# নৌকা ও পাল
পদব্রজে যাতায়াতের যতই সুবিধা থাকুক না কেন, আদিম মানবদের জলপথে গমনের কোনো উপায়ই জানা ছিল না, সাঁতার কাটা ভিন্ন। অভিজ্ঞতাবৃদ্ধির সাথে সাথে যখন দেখা গেল যে, কতিপয় ভাসমান কাঠ একত্র বাঁধিয়া লইলে, উহার উপর আরোহণ করিয়া জলাশয় পার হওয়া যায়, তখন হইতে শুরু হইল ভেলার সাহায্যে জলাশয় পার হওয়া। ইহার পরবর্তী কালের মানুষ বড় বড় গাছের আস্ত খুঁড়ি গুঁড়িয়া এক প্রকার নৌকা প্রস্তুত করিতে শিখিয়াছিল। এই প্রকার নৌকা প্রস্তুতের প্রথা কোনো কোনো অঞ্চলে এখনও আছে। উহাকে বলা হয় গাছ নৌকা। এই নৌকার একটি বিশেষত্ব এই যে, আকারে উহা যত ছোট বা বড় হউক না কেন, উহার গড়ন হয় প্রায় একই রকম। কাজেই আদিম মানবেরা যতদিন গাছ নৌকা ব্যবহার করিয়াছিল, ততদিন পর্যন্ত নৌশিল্পের কোনো উন্নতিই হয় নাই। নৌশিল্পের উন্নতি শুরু হইয়াছে কাঠের তক্তা তৈর করিয়া তদ্বারা জোড়াতালি দিয়া নৌকা প্রস্তুতের কৌশল জানার পর।
তক্তা দ্বারা নৌকা প্রস্তুতের মস্ত বড় সুবিধা হইল এই যে, উহা দ্বারা আবশ্যকমতো যত বড় ইচ্ছা তত বড় এবং যে কোনোও গড়নের নৌকা তৈয়ার করা যায়। কালক্রমে নানা ধরণের নৌকা যথা –বজরা, ময়ূরপঙ্খী বা পানসি, ছিপ, আল্কি ইত্যাদি প্রস্তুত হইতেছিল এবং বড় বড় জলাশয়ে পাড়ি জমানো সম্ভব হইয়াছিল, এমনকি সাগরবুকেও।
জলপথে যাতায়াত সম্ভব এবং ছোট ছোট নৌকা চালানো সহজসাধ্য হইল বটে, কিন্তু বড় বড় নৌকা চালনা করা ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। কালক্রমে এই কষ্টসাধ্য নৌ-চলাচল সহজসাধ্য হইল, যখন হইতে হইল নৌকায় পাল খাটাইবার ব্যবস্থা। খ্রী. পূ. ৩০০০ বৎসর পূর্বেই পালের নৌকার আবিষ্কার হইয়াছিল।[৩২]
নৌকা ও পাল আবিষ্কারের ফলে দেশান্তরে যাতায়াত ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ সুগম হইয়াছিল। মানুষ পাইয়াছিল জলে ও স্থলে অবাধে চলিবার স্বাধীনতা। আধুনিক যন্ত্রযুগের দ্বার পর্যন্ত মানব সভ্যতাকে আগাইয়া দিয়াছে নৌকা ও পাল। বলা বাহুল্য যে, এই যান্ত্রিক জলযানের যুগেও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পালের নৌকা এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়া আছে।
.
# লিপি ও কাগজ
আদিম মানবদের একের মনোভাব অপরকে জানাইতে মৌখিক আলাপ ও অঙ্গভঙ্গি ভিন্ন অন্য কোনো উপায় ছিল না। জ্ঞানোন্মেষের সাথে সাথে আবিষ্কৃত হইল চিত্রের মাধ্যমে মনোভাব ব্যক্ত করিবার কৌশল। কিন্তু উহা ছিল ভাবপ্রকাশের অতি সংক্ষিপ্ত আভাস মাত্র। যদি বলিতে হইত যে, তিনজন লোক নৌকাযোগে তিনদিনে একটি হ্রদ পার হইয়াছে, তবে চিত্রে দেখাইতে হইত– একখানা নৌকায় তিনজন আরোহী এবং তিনটি সূর্য।
মিশরে চিত্রলিপি শুরু হইয়াছিল প্রায় ছয় হাজার বৎসর পূর্বে। চিত্রলেখা বেশি সময়সাপেক্ষ এবং উহাতে যোগ্যতাও লাগে যথেষ্ট। তাই পরবর্তীকালে ছবি আঁকার বদলে আরম্ভ হইয়াছিল বিভিন্ন ধরণের দাগ কাটিয়া মনোভাব ব্যক্ত করিবার রীতি এবং বিভিন্ন দাগের সমন্বয়ে অক্ষর ও শব্দের সৃষ্টি। বলা বাহুল্য যে, বিভিন্ন দেশের লোক একই রীতির অনুসরণ করে নাই এবং তৎকালীন সকল রকম লিখনপ্রণালীও অধুনা প্রচলিত নাই। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে পুরাকালের যে সমস্ত লিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে, এখনও তাহার অনেকগুলির পাঠোদ্ধার সম্ভব হয় নাই।