.
আদি মনুর পৌত্র সপ্তমনুর মধ্যে কাহারও স্ত্রীর নামোল্লেখ নাই। অথচ তাহাদের বংশাবলীতে নাকি বর্তমান জগত মানুষে ভরপুর।
প্রজাপতিরাই নাকি সৃষ্টি করিয়াছেন একাধারে যক্ষ, রাক্ষস, পিশাচ, গন্ধর্ব, অপ্সরা, অসুর ইত্যাদি এবং মানুষ, পশু, পাখি, বজ, নক্ষত্র ইত্যাদি সবই! পরেরগুলির অধিকাংশই পৃথিবীতে এখনও দেখা যায়। কিন্তু যক্ষ, রাক্ষস, পিশাচ, গন্ধর্ব, অপ্সরা, অসুর ইত্যাদি গেল কোথায়?
মানুষ ও অন্যান্য জীবাদির জন্ম হইয়াছে নাকি প্রজাপতিদের ‘বংশে। কিন্তু মেঘ, বিদ্যুৎ, বজ্র, নক্ষত্র উহাদের বংশে জন্মিল কি রকম। বলা যাইতে পারে যে, প্রজাপতিরা জন্মদাতা নহেন, উহারা সৃষ্টিকর্তা। যদি তাহাই হয়, তবে সৃষ্টিকর্তা হন ব্রহ্মা, বিরাট পুরুষ, মনু ও দশ প্রজাপতি সমেত মোট তেরজন। চৌদ্দ ভুবনে চৌদ্দজন হওয়াই উচিত ছিল।
পৃথিবীতে নিত্য-নূতন জীবসৃষ্টি এখনও হইতেছে। কিন্তু প্রজাপতিরা কেহই বাঁচিয়া নাই। উহারা পরলোক গমনান্তে স্বর্গে বাস করিতেছেন। উত্তর আকাশে সপ্তর্ষিমণ্ডল নামে যে। নক্ষত্রমণ্ডলটি আছে, উহা স্বর্গবাসী প্রজাপতিদেরই মণ্ডল। ওইখানেই নাকি নক্ষত্রের আকারে। সাতজন প্রজাপতি বাস করিতেছেন। যথা –মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, বশিষ্ঠ এবং তাঁহার স্ত্রী অরুন্ধতীও। কিন্তু উহারা বর্তমান দুনিয়ায় জীবাদি সৃষ্টির প্রতি আদৌ মনোযোগী নহেন। রাত্রিকালে মিটিমিটি চাহিতেছেন মাত্র।
.
# পার্সি ধর্ম
ইরান দেশের পার্সি ধর্মের প্রবর্তক জোরওয়াস্টার এবং প্রধান ধর্মগ্রন্থের নাম জেন্দ-আভেস্তা। ঐ ধর্মে সৃষ্টিকর্তার নাম অহুর-মজদা। জেন্দ-আভেস্তার মতে, অহুর-মজদার ইচ্ছাক্রমে পৃথিবী ও মনুষ্যাদি প্রাণীকুলের সৃষ্টি হইয়াছিল। কিন্তু জেন্দ-আভেস্তার অংশবিশেষে দুইজন সৃষ্টিকর্তার আভাস পাওয়া যায়।
শেষোক্ত মতে– সৎপদার্থের বা সদগুণসমূহের সৃষ্টিকর্তা একজন এবং অসৎপদার্থ বা অসদগুণের সৃষ্টিকর্তা অপর একজন। সংসারে যত কিছু সৎসামগ্রী অর্থাৎ ভালো, তাহা সৃষ্টি করিয়াছেন অহুর-মজদা (আল্লাহ) এবং যত কিছু অসৎসামগ্রী বা মন্দ, তাহার সৃষ্টিকর্তার নাম আহরিমান (শয়তান)।
ইরানীয়গণের ধর্মগ্রন্থে প্রকাশ –ঐ দুই সৃষ্টিকর্তা আপন আপন স্বভাবের অনুরূপ প্রাণীসমূহ সৃষ্টি করেন। তিন সহস্র বৎসরকাল ঐ দুই সৃষ্টিকর্তার দুই রকম সৃষ্ট প্রাণী দুইটি কল্পরাজ্যে অবস্থিত ছিল। তৎপরে অসদাত্মা আহরিমান সদাত্মার সৃষ্ট প্রাণীর সহিত বিবাদে প্রবৃত্ত হয়। সেই বিবাদের ফলে উভয়ের মধ্যে সন্ধিশর্ত ধার্য হইয়াছিল। তাহাতে অহুর-মজদা নির্দেশ করিয়া দেন, সংসারে নয় হাজার বৎসর আহরিমানের প্রাধান্য থাকিবে, তন্মধ্যে তিন হাজার বৎসর তিনি সর্ববিষয়ে প্রাধান্য লাভ করিতে পারিবেন।
পারসিকদের ধর্মগ্রন্থে আরও লিখিত আছে– পবিত্ৰাত্ম অহুর-মজদা একটি বিশেষ মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক শেষোক্ত তিন হাজার বৎসর আহরিমানকে বিপর্যস্ত করিয়া ফেলেন। সেই সময়ে অহুর-মজদা কর্তৃক স্বর্গীয় দূত (ফেরেশতা) সমূহ এবং পৃথিবী সৃষ্ট হয়। সেই সময়েই চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র প্রভৃতিকে অহুর-মজদা সৃষ্টি করিয়াছিলেন। ইহার পর আপনার সৃষ্ট দৈত্যগণ কর্তৃক উৎসাহিত হইয়া অসদাত্মা আহরিমান পুনরায় অহুর-মজদার সৃষ্ট পদার্থসমূহ ধংস করিতে বদ্ধপরিকর হয়। তখন অহুর-মজদার সৃষ্ট আকাশ, জল, পৃথিবী, গ্রহ-উপগ্রহ, প্রাণীসমূহের আদিভূত বৃষ এবং সৃষ্টির আদিমনুষ্য ‘গেওমাড’ প্রভৃতির সহিত দৈত্যগণের ঘোর যুদ্ধ চলিতে থাকে (শয়তানের দাগা)।
জেন্দ-আভেস্তার মতে– এই পৃথিবী ক্রমে ক্রমে ছয় বারে (দিনে) সৃষ্ট হইয়াছে (ইহা পবিত্র বাইবেল ও কোরানে অনুমোদিত)। প্রথম বারে আকাশ সৃষ্ট হইয়াছিল, দ্বিতীয় বারে জল, তৃতীয় বারে পৃথিবী, চতুর্থ বারে বৃক্ষাদি, পঞ্চম বারে প্রাণীসমূহ এবং ষষ্ঠ বারে গেওমাড নামক মনুষ্য (আদম?) সৃষ্ট হইয়াছিল।
.
# ইহুদি ও খ্রীস্টান ধর্ম
পবিত্র বাইবেল গ্রন্থখানা কতগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রন্থের সমষ্টি এবং উহা দুই অংশে বিভক্ত। যাহারা প্রথম অংশ মানিয়া চলেন, তাহাদিগকে বলা হয় ইহুদি এবং যাহারা দ্বিতীয় অংশ মানিয়া চলেন, তাহাদিগকে বলা হয় খ্রীস্টান। কিন্তু প্রথমাংশের ‘আদিপুস্তক’ (Genesis) খানা ইহুদি ও খ্রীস্টান উভয় সম্প্রদায়ই মান্য করিয়া থাকেন এবং উভয় সম্প্রদায়ই সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে আদিপুস্তকখানার লিখিত বিবরণে বিশ্বাসী। কাজেই সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে উভয় সম্প্রদায়ের সাধারণ মতামত একই। এইখানে সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে আদিপুস্তকে লিখিত বিবরণের আলোচনা করা যাইতেছে।
আদিপুস্তক (১; ১) –“আদিতে ঈশ্বর আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করিলেন।”
সেকালের মানুষ তাহাদের সাধারণ দৃষ্টিতে দেখিত যে, বিশালতায় আকাশ প্রথমস্থানীয় ও পৃথিবী দ্বিতীয়। তাই বলা হইত, প্রথম সৃষ্ট হইয়াছে আকাশ, পরে পৃথিবী। কেননা বৈদিক ও পারসিক গ্রন্থেও অগ্রে আকাশ সৃষ্টির বিবরণ পাওয়া যায় (মনু : ১; ৮)।
এককালে আকাশকে মনে করা হইত কোনো পদার্থের তৈয়ারী, পৃথিবীর উপরে বৃহৎ ঢাকনি। স্বরূপ। মনে করা হইত –চাঁদ, তারা, সূর্য আকাশের গায়ে লটকানো আছে এবং আকাশ হইতেই শিলা, বৃষ্টি, বজ্র ও তদূর্ধের স্বর্গ হইতে উল্কাপাত হইয়া থাকে। বস্তুত আমরা ঊর্ধ্বদেশে যে। নীলবর্ণের দৃশ্যটি দেখিয়া থাকি, উহা মহাশূন্য বটে। চাঁদ, সূর্য ও তারকারা সকলেই মহাশূন্যে অবস্থিত আছে, এমনকি এই পৃথিবীও।