.
# ধাতু ও গৃহ
বলা হয় যে, পাখিরা বিমানবিহারী জীব। কিন্তু বিমানে বিহার কতক্ষণ? বেশির ভাগ সময়ই উহাদের দাঁড়াইতে হয় বৃক্ষশাখায়। আবার বৃক্ষশাখায় দাঁড়াইয়া থাকা চলে না, বসতে হয়, অন্তত ডিম পাড়া বা ডিমে তা দিবার সময়ে। তাই উহারা খড়কুটা বা অন্য কিছুর দ্বারা একটু স্থান করিয়া লয় বসার, বলা হয় –বাসা। মানুষ যখন বৃক্ষচারী ছিল, যে রকমই হউক, তখন তাহারাও তৈয়ার করিত বাসা। কালক্রমে মাটিতে নামিয়া আসিবার পর মানুষ গিরিগুহা বা বৃক্ষকোটরে বাস করিত। আবার কোনো সময়ে বাসা তৈয়ার করিয়া উহাতে বাস করিত। আজিও আমরা অফিসাদি কর্মস্থল হইতে ফিরিবার সময়ে বলি, “বাসায় যাই”।
আদি মানবেরা গুহাবাসী ছিল বটে, কিন্তু সবসময়েই গুহা পাওয়া যাইত না। তখন পর্বত বা বৃক্ষের গা ঘেঁষিয়া ডালপালা জড়ো করিয়া তাহার উপর লতা-পাতার ছাউনি দিয়া বাসা বানানো হইত, যেন কৃত্রিম গুহা। উহাকে গৃহ বলা চলে না। কেননা উহাতে থাম-খুঁটি বা ভিটি-বেড়া ছিল না। তখন ডালপালা ও লতা-পাতা ইত্যাদি সরঞ্জাম সবই সংগ্রহ করিতে হইত ভাঙ্গিয়া বা ছিঁড়িয়া। যেহেতু হাতিয়ার বলিতে উহাদের কিছুই ছিল না, একমাত্র পাথর ভিন্ন। মানুষ প্রকৃত গৃহবাসী হইয়াছে ধাতু বিশেষত লৌহ আবিষ্কারের পর।
প্রায় পাঁচ লক্ষ বৎসর আগে মানুষ গাছ হইতে নামিয়া মাটিতে চলাফেরা শুরু করে। তখন তাহারা খাদ্য তৈয়ার করিতে জানে না, নির্ভর মাত্র শিকার ও সংগ্রহের উপর। মানুষের এই অবস্থাকে মর্গান বলিয়াছেন বন্যদশা, প্রত্নতত্ত্ববিদগণ বলেন পুরানো পাথর যুগ এবং ভূতত্ত্ববিদগণ বলেন প্লিসটোসেন। উক্ত পাঁচ লক্ষ বৎসরের প্রায় পৌনে ষোল আনা সময়ই কাটিয়াছে মানুষের বন্যদশায়।
মানুষ কৃষি ও পশুপালন শিখিয়াছে এবং নিজেরাই খাদ্য উৎপাদন করিতে জানে –মর্গান এই অবস্থার নাম দিয়াছেন বর্বরদশা, প্রত্নতত্ত্ববিদগণ বলেন নতুন পাথর যুগ এবং ভূতত্ত্ববিদগণ বলেন হলোসেন। এই যুগটি প্রায় দুই হাজার বৎসর স্থায়ী ছিল।
প্রায় পাঁচ হাজার বৎসর আগে নীল, ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস এবং সিন্ধু উপত্যকায় যে সভ্যতা গড়িয়া উঠে, মর্গান উহার নাম দিয়াছেন সভ্যদশা। এই সভ্যদশার দুইটি ভাগ আছে। যথা –১. তাম্র ও ব্রোঞ্জ যুগ, প্রায় দুই হাজার বৎসর এবং ২. লৌহ যুগ, প্রায় তিন হাজার বৎসর।
ধাতু যুগের শুরুতে পাথরের হাতিয়ারের পরিবর্তে মানুষ তাম্র বা ব্রোঞ্জ দ্বারা হাতিয়ার নির্মাণে সক্ষম হইয়াছিল এবং উহাতে সুবিধাও হইয়াছিল অনেক। কিন্তু লৌহ আবিষ্কারের মতো উহা সুদূরপ্রসারী ছিল না। ব্রোঞ্জ বা তাম্ৰধাতু আজিও আছে এবং শিল্পক্ষেত্রে উহার কিছু গুরুত্বও আছে। কিন্তু আধুনিক সভ্যতা পুরাপুরি নির্ভর করিতেছে লৌহের উপর, ব্রোঞ্জ বা তাম্রের উপর নহে।
লৌহযুগের প্রাথমিক মামুলি হাতিয়ার ছিল কাটারি, কাস্তে, কোদাল, কুড়াল, করাত ইত্যাদি এবং ইহারই সাহায্যে সম্ভব ও সহজ হইয়াছিল ভূমিকৰ্ষণ, বৃক্ষছেদন, গৃহনির্মাণ, নৌকা তৈয়ার ইত্যাদি। ফলে উন্নত হইয়াছিল কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য, এক কথায় জীবনযাপন প্রণালী। প্রকৃতপক্ষে লৌহ আবিষ্কারই করিয়াছে জগতে আধুনিক সভ্যতার ভিত্তিপত্তন।
.
# তাঁত
পবিত্র বাইবেল গ্রন্থের মতে, আদিমানব আদম সৃষ্ট হইয়াছিল খ্রী. পূ. ৪০০৪ সালে। অর্থাৎ এখন (১৯৭০) হইতে প্রায় ছয় হাজার বৎসর পূর্বে। ঐ সময়ে হযরত আদম এদন উদ্যানে (বেহেশতে?) বাস করিতেন এবং তিনি ঐখানে উলঙ্গ ছিলেন। তৌরিতে লিখিত আছে, “তখন সদাপ্রভু ঈশ্বর আদমকে ডাকিয়া কহিলেন, তুমি কোথায়? তিনি কহিলেন, আমি উদ্যানে তোমার রব শুনিয়া ভীত হইলাম, কারণ আমি উলঙ্গ, তাই আপনাকে লুকাইয়াছি। … আর সদাপ্রভু ঈশ্বর আদম ও তাহার স্ত্রীর নিমিত্ত চর্মের বস্ত্র প্রস্তুত করিয়া তাহাদিগকে পরাইলেন।” (আদিপুস্তক ৩; ৯, ১০, ২১)
জীবতত্ত্ববিদগণ বলেন যে, চেহারায় পশুর কোঠা পার হইবার পরেও আহার-বিহার ও চাল চলনে মানুষ পশুবৎ ছিল এবং উলঙ্গ থাকিত। জ্ঞানোন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে বৃক্ষপত্র বা বল্কল এবং পশুচর্ম পরিধান করিতে থাকে। এমনকি শীত নিবারণের জন্যও তাহারা পশুচর্মই ব্যবহার করিত। বর্তমান যুগেও এস্কিমো বা অনুরূপ অসভ্য জাতিরা পশুচর্ম পরিধান করিয়া থাকে।
পোষাক-পরিচ্ছদে মানুষ সুসভ্য হইতে পারিয়াছে সুতা তৈয়ার ও তাত আবিষ্কারের পরে। বস্তুত সভ্যতা বিকাশের একটি বিশিষ্ট ধাপ হইল বস্ত্রবয়ন বা তঁত আবিষ্কার।
.
# মাল বহিবার কাজে পশু
আদিম মানবেরা মালবহন কাজে ব্যবহার করিত তাহাদের হাত, মাথা, ঘাড়, পিঠ ইত্যাদি। কিন্তু এইভাবে মাল বহন করা, পরিমাণে অল্প ও সামান্য দূরেই সম্ভব। বেশি পরিমাণ মাল লইয়া দেশান্তরে গমন করা ছিল দুঃসাধ্য। কৃষি ও পশুপালনের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল যে, কতক পশুর দ্বারা মাল বহনের কাজও করানো যায়, যেমন –ঘোড়া, গাধা, উট ইত্যাদি। দশটি মানুষের বহনযোগ্য মাল হয়তো একটি পশুই অনায়াসে বহুদুর বহন করিয়া লইয়া যাইতে পারে। তাই শুরু হইল মাল বহনের কাজে পশুর ব্যবহার। ইহাতে এক দেশের মানুষের সহিত আর এক দেশের মানুষের লেনদেন অর্থাৎ স্থলপথে বাণিজ্য সম্ভব হইয়াছিল। মানুষকে সভ্যতার আর এক ধাপ উপরে উঠাইয়া দিয়াছিল মাল বহিবার কাজে পশুর ব্যবহার।