কুকুর মানুষের পোষ মানিয়াছিল গবাদি পশু পোষ মানিবার অনেক আগেই। আদি মানবদের আস্তানার আশেপাশে পড়িয়া থাকিত বন্য পশুর হাড়গোড় ও ত্যাজ্য অংশ। একদল নেকড়ে জাতীয় বন্য পশু (কুকুর) উহা খাইতে আসিত ও আস্তানার কাছে কাছে নির্ভয়ে ঘোরাফেরা করিত, তাড়াইয়া দিলেও আবার আসিত। শিকারীরা উহাদের কিঞ্চিৎ সহানুভূতি দেখাইলে উহারা শিকারীদের অনুগত ও সহচররূপে গণ্য হইয়াছিল।
কালক্রমে গবাদি পালিত পশুর সংখ্যাবৃদ্ধি হইয়া অবস্থা এইরূপ দাঁড়াইল যে, সংবৎসর উহাদের দুগ্ধ ও মাংস খাইলেও উহাদের সংখ্যা বাড়ে বৈ কমে না, তখন বন্যপশু শিকার ত্যাগ করিয়া দলের সকলেই মনোযোগ দিল পশুপালনে। কিন্তু অচিরেই একটি অসুবিধায় পড়িতে হইল পশুপালকদের। স্থায়ী আস্তানায় থাকিয়া শত শত বা হাজার হাজার পশুর খাদ্য জোগানো হইল অসম্ভব। কাজেই উহারা আস্তানা ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইতে বাধ্য হইয়াছিল অন্য অঞ্চলে পশুপাল সহ। সেখানকার তৃণাদি পশুখাদ্য নিঃশেষ হইলে আবার খোঁজ করিতে ও চলিয়া যাইতে হইত যেখানে তৃণসমাকুল মাঠ আছে সেখানে। এইভাবে পশুপালনরত ভ্রাম্যমান মানবদলসমূহই বনিয়াছে যাযাবর জাতি।
শিকার ও সংগ্রহের যুগের প্রথম দিকে নারী ও পুরুষের কাজের ভাগাভাগি ছিল না। সকলে মিলিয়া দল বাধিয়া বাহির হইত ও ছোট ছোট জন্তু-জানোয়ার তাড়াইয়া-ঝাপাইয়া হাতেই ধরিত এবং এই কাজে মেয়েরা যথাসাধ্য সাহায্য করিত। কিন্তু বল্লম আবিষ্কারের পর যখন হরিণ, মহিষ ও ভালুকাদি বড় বড় জন্তু শিকার শুরু হইল, তখন আর সেই কাজে মেয়েদের সাহায্য করা সম্ভব হইল না। কেননা মেয়েদের উপর আর একটি অতিরিক্ত কাজের ভার ছিল— শিশুপালন। মেয়েরা তখন বনে বনে ঘুরিয়া ফলমূল সংগ্রহ করিত মাত্র।
সেই আদিম কালের মেয়েরা ফলমূল সংগ্রহ করিবার সময় এমন দুই-একটি ফলের থোকা পাইয়াছিল যে, উহার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফলগুলি বেশ সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। ফলগুলি ক্ষুদ্র বলিয়া উহা যখন তখন খাওয়া চলিত না। তাই ঐগুলি আস্তানায় লইয়া আসিত এবং অবসর সময়ে খুঁটিয়া খুঁটিয়া উহার দানা খাইত। হয়তো ঐ রকম দুই-চারিটি ফলের গোটা আস্তানার আশেপাশে পড়িয়া তাহা হইতে গাছ জন্মিত ও ফল ধরিত। মেয়েরা যখন উহার উৎপত্তি সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল হইল, তখন বুঝিতে পারিল যে, দানাগুলি সরস মাটিতে চাপা থাকিয়াই উহাদের অকুরোদগম হইয়াছে। তাই উহারা সরস মাটিতে বীজ পুঁতিয়া গাছ জন্মাইয়া উহা হইতে বেশি বেশি ফসল পাইতে লাগিল এবং খুঁটিয়া খাওয়ার পরিবর্তে পাথরে পিষিয়া উহার মণ্ড ভক্ষণ শুরু করিল। ইহাতে। ফলমূল সংগ্রহের ব্যাপারে উহারা অনেকটা আত্মনির্ভরশীল হইয়া উঠিল। এইভাবে আদিম কালের মেয়েদের হাতেই প্রবর্তন হইল গম ও বার্লির চাষ অর্থাৎ কৃষিকাজের সূচনা। বস্তুত পৃথিবীতে কৃষিকাজের প্রবর্তন করিয়াছে নারীরা, যীশু খ্রীস্ট জন্মিবার প্রায় সাড়ে চারি হাজার বৎসর আগে।[৩০]
গরু মহিষের শিং, সূঁচালো কাঠ বা অনুরূপ অন্য কিছুর দ্বারা খেচাইয়া খোঁচাইয়া মাটি আলগা করিয়া বীজ বপন করাই ছিল তখনকার দিনের কৃষি। বোঝাই যাইতেছে যে, এইভাবে বেশি জমি চাষ করা সম্ভব নহে। কৃষিকাজের সামান্য প্রসার হইয়াছিল কোদাল আবিষ্কারের পর। সে কিন্তু আধুনিক কোদাল নহে। হরিণের শিং, বাঁকানো কাঠ বা কাঠে বঁধা একখণ্ড সূঁচালো পাথর মাত্র। উহা দ্বারা কোপাইয়া (খোঁচাইয়া নহে) মাটি আলগা করিয়া বীজ বপন করা হইত। এই ব্যবস্থামতো শত শত বৎসর কৃষিকাজ চালাইয়াছিল আদিম মানবেরা। এই সময়টিকে বলা হয় কোদাল দ্বারা চাষ করার যুগ, সংক্ষেপে কোদাল যুগ। এই যুগে চাষ বা ফসলের মাত্রা কিছু বাড়িয়াছিল বটে, কিন্তু শিকার ও সংগ্রহ ত্যাগ করিয়া মানুষ স্বাবলম্বী হইতে পারে নাই। তবে। শিকারের তাগিদ কিছু কমিয়াছিল।
যীশু খ্রস্টের জন্মের তিন হাজার বৎসর আগেই মিশর, মেসোপটেমিয়া এবং ইহার কিছুকাল। পরে ভারতবর্ষ, সাইপ্রাস, চীন ও গ্রীসে বঁড় বা গাধা দিয়া লাঙ্গল টানাইবার পরিচয় পাওয়া যায়। তখন শিকার ও সংগ্রহের যুগ শেষ হইয়া আসিয়াছে। কোদাল যুগের পরিবর্তে রীতিমতো কৃষিযুগ শুরু হইয়াছে। আবাদী জমি ও ফসলের পরিমাণ যথেষ্ট বাড়িয়াছে। মানুষ খাদ্যের ব্যাপারে হইতে পারিয়াছে স্বাবলম্বী। বস্তুত খাদ্যসংস্থানে পশু-পাখির পর্যায় হইতে মানুষকে মানুষ পর্যায়ে উন্নীত করিয়াছে পশুপালন ও কৃষি।
আজকাল যেমন নিতান্ত নীরস ও অনুর্বর মাটিতেও নানান কৌশলে সেচ ও সারের ব্যবহার করিয়া ফসলোৎপাদন করা হইয়া থাকে, আদিতে কিন্তু তাহা ছিল না। তখন চাষের কাজের সম্পূর্ণ নির্ভর ছিল প্রকৃতির উপর। যে দেশের মাটি স্বভাবতই সরস ও উর্বর, মাত্র সেই দেশেই। ব্যাপকভাবে কৃষিকাজ শুরু হইয়াছিল সবচেয়ে আগে। তাই নীল, ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস এবং সিন্ধু। নদীর বদৌলতে মিশর, মেসোপটেমিয়া ও ভারতের সিন্ধু প্রদেশে সর্বাগ্রে ব্যাপকভাবে কৃষিকাজ শুরু হইয়াছিল। আর যে দেশের মানুষ বৎসরের এক বিশেষ সময়ে ফসল জন্মাইয়া সংবৎসরের খাদ্যের সংস্থান করিতে পারে, তাহারাই পারে অবসর সময়ে অন্যান্য চিন্তা ও কাজ করিতে। তাই শিল্পক্ষেত্রেও ঐ তিনটি দেশ হইয়াছিল অগ্রণী। কাজেই উক্ত দেশত্রয়কেই বলা হয় মানব সভ্যতার কেন্দ্রভূমি। নানা রকম প্রমাণ হইতে পণ্ডিতগণ এই সিদ্ধান্তই করিয়াছেন যে, ঐ তিনটি দেশে সভ্যতার জন্ম হইয়াছিল খ্রী. পূ. ৩৫০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে।[৩১]