অগ্নি একজন দিকপাল, পূর্ব ও পশ্চিম দিকের অধিপতি। হঁহার স্ত্রীর নাম স্বাহা। মহাভারতে উক্ত আছে যে, একদা স্বেতকী রাজার যজ্ঞে প্রচুর পরিমাণে হবিভোজন করিয়া অগ্নির পেটে অসুখ হইয়াছিল। ব্রহ্মার নিকট রোগের প্রতিকারের পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি অগ্নিকে বলিলেন যে, খাণ্ডব বন দগ্ধ করিতে পারিলে তোমার রোগ আরোগ্য হইতে পারিবে। অনন্তর অগ্নি খাণ্ডব বন দগ্ধ করিবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন।
কিন্তু দেবাশ্রিত বন সহজে দগ্ধ করিতে সমর্থ হইবেন না বুঝিতে পারিয়া অগ্নি কৃষ্ণার্জুনের সাহায্যপ্রার্থী হইলেন। অর্জুন সাহায্য করিতে স্বীকৃত হইলেন বটে, কিন্তু বলিলেন যে, দেবগণের সহিত যুদ্ধ করিতে হইলে যে সকল অস্ত্র-শস্ত্রের প্রয়োজন, তাহা তাহার নাই। অগ্নি অস্ত্র-শস্ত্র সংগ্রহ করিয়া দিবেন বলিয়া স্বীকৃত হইয়া স্বীয় সখা বরুণদেবের নিকট গমনপূর্বক অনেকগুলি অস্ত্র সংগ্রহ করিলেন। তাহা হইতে কপিধ্বজ রথ, গাণ্ডীব ধনু ও অক্ষয় তূণীরদ্বয় অর্জুনকে এবং সুদর্শন চক্র, কৌমোদকী গদা কৃষ্ণকে প্রদত্ত হইল। খাণ্ডব বন দহনে দেবগণ বাধা দিলে কৃষ্ণার্জুনের সহিত তাহাদের ঘোরতর যুদ্ধ হইল। যুদ্ধে দেবগণ হারিয়া গেলেন। অগ্নি খাণ্ডব বন দগ্ধ করিলে তাহার পেটের অসুখ সারিয়া গেল।
পারসিকগণ মনে করেন যে, অগ্নি মঙ্গলময়, তাহাদের ইহকাল ও পরকালের মগল বিধান করিবেন অগ্নি। তাই তাহাদের পরমারাধ্য দেবতাই হইলেন অগ্নি।
ইহুদিগণ মনে করেন যে, মাংসপোড়া পূতগন্ধ মানুষের কাছে যখন লোভনীয়, নিশ্চয়ই উহা জাভে (ইহুদিদের ঈশ্বর)-এর নিকটও লোভনীয়। তাই ইহুদিরা জাভে-এর তুষ্টার্থে গো-মেষাদি বলি দিয়া উহার মাংস অগ্নিদগ্ধ করিয়া আকাশে ধুয়া উড়াইতেন।
.
# কৃষি ও পশুপালন
সেমিটিক জাতির মতে, কৃষি ও পশুপালন শুরু করিয়াছিলেন বাবা আদম বেহেশত হইতে পৃথিবীতে আসিয়াই। হালের বলদ, লাঙ্গল-জোয়াল ও ফসলের বীজ বেহেশত হইতে আমদানি হইয়াছিল কি না, তাহা জানি না, তবে তিনি নাকি চাষাবাদ করিয়াই জীবন যাপন করিতেন। তাহার চাষের ফসল ছিল বোধ হয় গন্ধ)ম। কেননা, তিনি নাকি খাইতে ভালোবাসিতেন উহাই।
সেকালের মিশরবাসীদের লাগলে ছিল একটি ফাল ও দুইটি হাতল। একজন চাষী দুই হাতে হাতল চাপিয়া ধরিত এবং অপর একজন গরু তাড়াইত, জোয়াল জোড়া হইত গরুর শিং-এর সাথে।[২৯] বাবা আদমের লাগলের আকৃতি কিরূপ ছিল, জোয়াল কিভাবে জুড়িতেন এবং রশা রশি কোথায় পাইয়াছিলেন –সেই বিষয়ে কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না।
পুরাতত্ত্ববিদগণের মতে, কৃষি ও পশুপালন কোনো বিশেষ ব্যক্তির দ্বারা কোনো এক সময়ে প্রবর্তিত হয় নাই। উহা হইয়াছে বহু দেশের, বহু লোকের, বহু দিনের প্রচেষ্টার ফলে। তবে কৃষি ও পশুপালন বা মানব সভ্যতার কেন্দ্রভূমি হিসাবে ধরা হয় মিশর, মেসোপটেমিয়া ও ভারতবর্ষের সিন্ধু প্রদেশকে।
কৃষি ও পশুপালন –ইহার কোনটি আগে শুরু হইয়াছে, তাহা নিশ্চিত বলা যায় না। হয়তো সমসাময়িক, নচেৎ পশুপালন কিছুটা আগের। পশুপালন আরম্ভ হইয়াছিল শিকারী যুগেই।
কৃষি ও পশুপালন প্রচলিত হইবার পূর্বে আদিম মানবদের খাদ্যব্যবস্থা ছিল পশু-পাখিদের মতো। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দল বাঁধিয়া উহারা খাদ্যের সন্ধানে বাহির হইত এবং সমস্ত দিন ঘোরাফেরা করিয়া পশু-পাখি শিকার বা ফল-মূল সংগ্রহ যাহা করিতে পারি, তাহা দিয়াই উদরপূর্তি করিয়া আস্তানায় আসিয়া নিদ্রা যাইত। আবার প্রভাতে যাত্রা, ঘোরাফেরা, জোটে তো খাওয়া, আর না জোটে তো না খাওয়া, সন্ধ্যায় আস্তানায় আসিয়া শোয়া। এইরূপ চলিত আদিম মানবদের জীবন যাপন। উহাদের কোনোরূপ সঞ্চয় বা মজুদ খাদ্য ছিল না, ছিল যখন পাওয়া তখন খাওয়া। আবার সকল দিন সমান যাইত না। হয়তো কোনদিন প্রচুর খাদ্য জুটিত, আবার কোনোদিন আদৌ জুটিত না।
হিন্দুদের ঈশ্বর নাকি গোমাংস ভক্ষণে নিষেধ করিয়াছেন, আবার মুসলমানদের আল্লাহ বলিয়াছেন, “শূকরের মাংস খাইও না”। কিন্তু খ্রীস্টানদের প্রভু বলিয়াছেন গরু ও শূকর উভয়ই খাইতে। কিন্তু খাদ্যাখাদ্য সম্বন্ধে ঈশ্বরপ্রদত্ত কোনো তালিকা ছিল না আদিম মানবদের কাছে। তাহারা খাদ্য নির্বাচন করিত উহা পাইবার ও খাইবার সুযোগ-সুবিধা মতো। আজিও দেখা যায় যে, ধর্মরাজ্যের বাহিরের বিভিন্ন উপজাতি ও অসভ্য সমাজে ছাগল, গরু, বাঘ, ভালুক, শূকর, কুমির, সাপ, ইঁদুর, ব্যাঙ ইত্যাদি খাওয়া হইতেছে সবই।
কোনো কোনো সময় শিকারীদের হাতেই কতক পশু জীবন্ত ধরা পড়িত। তখন আবশ্যকীয় খাদ্যের জোগান থাকিলে ঐগুলিকে আর বধ করা হইত না, বাঁধিয়া রাখা হইত –যেদিন শিকার। জুটিবে না, সেইদিন খাইবার জন্য। আবার কোনো কোনো সময় নিরীহ পশুর বাচ্চাদের বন। হইতে ধরিয়া আনা হইত। খাদ্যের অভাব না হইলে ঐরূপ কোনো কোনো পশু দীর্ঘদিন বাঁধা থাকিত এবং তখন দেখা যাইত যে, উহাদের সকলেই ছুট পাইলে পালায় না, আস্তানার কাছে। কাছে ঘোরাফেরা করে ও শিকারীদের দেওয়া খাবার খায়।
আদিম মানবেরা যখন দেখিল যে, দুই-চারিটি পশু এইরূপ মজুদ রাখিতে পারিলে তাহাদের আর খাদ্যের অনিশ্চয়তা থাকে না, তখন ঐ জাতীয় পশুদের আর সহজে বধ না করিয়া প্রতিপালন করিতে লাগিল। ইহাতে দেখা গেল যে, সময়ে উহারা বাচ্চা প্রসব করে এবং পালের। পশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাইতে থাকে। অধিকন্তু উহাদের দুগ্ধও ব্যবহার করা চলে। অবস্থা যখন এইরূপ হইল, তখন দলের সকলেই শিকারে বাহির না হইয়া কেহ কেহ থাকিতে লাগিল পালিত পশুর তত্ত্বাবধানে রাখালরূপে। এইভাবে হইয়াছিল পশুপালনের সূত্রপাত। অনেকের মতে আদিম। মানবদের প্রথম পালিত পশু ছিল বুনো ভেড়া ও বুনো ষড়।