প্রাকৃতিক অগ্নির আর একটি উৎস হইল উল্কা। উল্কারা পতনের সময় বায়ুর ঘর্ষণে জ্বলিয়া উঠে এবং কোনো কোনো সময় উহারা প্রজ্জ্বলিত অবস্থায় ভূপতিত হয়। কিন্তু উহা এতই ক্ষণস্থায়ী যে, কোনো মানুষ উল্কার আগুনের নাগাল পায় না।
উল্কাপাতের ন্যায় বজ্রপাতও ভূপৃষ্ঠে অগ্নি বহন করিয়া আনে। কিন্তু উহাও মানুষের কোনো উপকার করে না, করে শুধু অপকার। তবে বর্তমানে কোনো কোনো বিজ্ঞানী কৃত্রিম বজ্রপাতের দ্বারা ভূমি উর্বরা করিবার গবেষণা চালাইতেছেন।
কৃত্রিম অগ্নি
সচরাচর আমরা যে আগুন ব্যবহার করিয়া থাকি, তাহা হইল কৃত্রিম আগুন। এই আগুন কখন কাহারা আবিষ্কার করিয়াছিল, তাহা সঠিক বলিবার উপায় নাই। মানব সভ্যতার একটি প্রধান ধাপ আগুনের আবিষ্কার।
পুরাতত্ত্ববিদগণ সকলেই একবাক্যে স্বীকার করিয়াছেন যে, মানুষ এককালে পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করিত। একখানা পাথরকে আর একখানা পাথর দিয়া ঠুকিয়া ঠুকিয়া মনের মতো আকার দেওয়া বা দেওয়ার চেষ্টা করা হইত। পাথরে পাথর ঠুকিলে অনেক সময় তাহা হইতে ফুলকি নির্গত হইয়া থাকে এবং উহা ঐ সময়ও হইয়াছিল। বোধ হয় যে, ঐ রকম ফুলকিকে ভিত্তি করিয়া বা কাষ্ঠে কাষ্ঠে ঘর্ষণ করিয়া পুরানো পাথর যুগেই আগুনের আবিষ্কার হইয়াছিল।
আগুন আবিষ্কারের পূর্বে মানুষ মানুষ’ নামের অধিকারীই ছিল না। তখনকার মানুষদিগকে বলা যাইতে পারে– দ্বিপদ পশু না হইলেও দ্বিপদ জানোয়ার; কেননা, আগুন আবিষ্কারের পূর্বে বা কিছুকাল পরেও উহারা মাছ-মাংস কাঁচাই ভক্ষণ করিত। আদিম মানুষদের মাছ-মাংস কাঁচা ভক্ষণ করা যে কতটুকু কষ্টসাধ্য ছিল, তাহা ভাবাও সহজ নহে। মাছগুলিকে না হয় আঁচড়াইয়া-কামড়াইয়া থেঁতো করিয়া কোনো রকম উদরস্থ করা যাইত, কিন্তু গণ্ডার, ভালুক ইত্যাদি বড় বড় জন্তুগুলির চামড়া বা মাংস ছেঁড়া বড় সহজ ব্যাপার ছিল না। বিশেষত হাতের ও সঁতের জোর ভিন্ন হাতিয়ারের জোর পাথর ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তথাপি যে রকম করিয়াই হউক, উহারা যে ঐসকল জন্তুর মাংস ভোজন করিত, তাহার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে। আদিম মানবদের আস্তানার কাছাকাছি ঐ জাতীয় জন্তুদের হাড়গোড় দেখিয়া।
ফুলকির আগুনের দ্বারা খড়-কুটা জ্বালানো সহজ ব্যাপার নহে। কোথায়ও কোনোরূপ কায়ক্লেশে আগুন জ্বালাইতে পারিলে গোটা অঞ্চল উহাকে বীজরূপে ব্যবহার করিত এবং আগুনটিকে অনির্বাণ রাখা হইত। বর্তমান কালেও কোনো কোনো ধর্মমন্দিরে অনির্বাণ অগ্নি রক্ষার নিয়ম আছে।
আগুনের তাপ ও আলোর অলৌকিক শক্তি দেখিয়া আদিম মানবেরা বিস্ময়ে অভিভূত হইয়াছিল নিশ্চয়ই। তাহারা দেখিয়াছিল যে, অগ্নির কোমল দেহের কঠিন আঘাত সহ্য করিতে বাঘ, ভালুক বা হাতিও পারে না। আগুন দেখিলে উহারা কেহই উহার কাছে আসিতে সাহস পায়। না। সুতরাং আগুন দ্বারা হিংস্র জন্তু তাড়ানো যায়। আগুনে সেঁক দিলে মাছ-মাংস কোমল ও সুগন্ধী হয় (আগুনে সেঁকা মাংস ‘কাবাব’ খাওয়ার রেওয়াজ এখনও কিছু কিছু আছে)। আগুনকে দেখিলে বাঘ-ভালুকের অপেক্ষাও দ্রুত পালায় অন্ধকার। অন্ধকার ছিল আদিম মানবদের চিরশত্রু ও চিরসহচর। কেননা চাঁদ-সূরুজের উপস্থিতি ভিন্ন জীবনের বাকি সময় অন্ধকারেই কাটাইত আদিম মানবেরা। অন্ধকার প্রহরগুলি উহাদের শুইয়া, বসিয়া, জাগিয়া বা ঘুমাইয়া কাটাইতে হইত; কেহ কাহারও মুখ পর্যন্ত দেখিতে পাইত না। আগুন আবিষ্কারের পর দেখা গেল যে, আগুনের আলোয় রাত্রেও দেখা-সাক্ষাত ও কাজকর্ম করা বেশ চলে। বিশেষত দারুণ শীতের সময় যখন দেহ ঠকঠক করিয়া কাপিতে থাকে, তখন আগুনের কাছে আসিলে দেহ চাগা হয়।
আদিম মানবেরা লক্ষ্য করিয়াছিল, আগুনের একটি আশ্চর্য ক্ষমতা এই যে, আগুনে পোড়াইলে কোনো পদার্থেরই পূর্বরূপ বজায় থাকে না; জীব বা উদ্ভিদ, এমনকি মাটি পাথরেরও। আগুন বহু রূপকে পরিণত করে এক রূপে, অগার বা ভস্মে।
মানুষ তখন আর শিয়াল-কুকুরের মতো কঁচামাংসভোজী নহে, সে তখন সেঁকা বা পোড়ামাংসভোজী জীব। যখন তাহারা লক্ষ্য করিল যে, মাটি পোড়াইলে উহা কাষ্ঠাদির ন্যায় কয়লা বা ভস্মে পরিণত হয় না বটে, কিন্তু কঠিন অবস্থা প্রাপ্ত হয়, তখন এই তথ্যটির সাহায্যে বানানো হইল পোড়ামাটির পাত্র। শুরু হইল মাছ-মাংস রান্না করিয়া খাওয়া। কিন্তু এই রান্নার অর্থ আধুনিক রান্না নহে। উহাতে হলুদ-মরিচ বা তৈল-লবণের সম্পর্ক ছিল না, উহা ছিল মাছ মাংস সিদ্ধ করিয়া খাওয়া।
আগুন আবিষ্কারের পর মানুষ পশুর কোঠা পার হইয়া অনেক দূর আগাইয়া গিয়াছিল। কিন্তু একদল ভাবুক তাহাদের ভাবনা চালাইলেন অন্য পথে। তাহারা ভাবিলেন, অগ্নি আমাদের পরম উপকারী এবং সময়ে অপকারীও বটে। সুতরাং উপকারের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও অপকারের জন্য উহার স্তুতিগান করা উচিত। অগ্নিকে কল্পনা করা হইল ব্যক্তি রূপে, দেওয়া হইল দেবত্ব, প্রবর্তিত হইল উহার পূজার বিধি।
প্রথমে ভারতের দিকেই চাহিয়া দেখা যাক, ভারতীয়রা আগুনকে লইয়া তাহাদের কল্পনার ঘোড়া দৌড়াইয়াছেন কতদূর। কথিত হয়, পরম পুরুষের মুখ হইতে ইহার জন্ম হয়। মতান্তরে ধর্মের ঔরসে বসুভার্যার গর্ভে অগ্নির জন্ম হয়। ঋগ্বেদে বর্ণিত আছে যে, অগ্নি স্থুলকায়, রক্তবর্ণ ও লম্বোদর; হঁহার কেশ, শ্মশ্রু, ভূ ও চক্ষু পিঙ্গলবর্ণ; হস্তে শক্তি ও অক্ষসূত্র। ইহার বাহন ছাগ।