সভ্যতার বাল্যাবস্থা –এই অবস্থায় সমাজের অধিনায়ক ছিলেন মুনি-ঋষি, নবী-আম্বিয়া বা আঞ্চলিক জ্ঞানী ব্যক্তিরা। জীবনের মানোন্নয়নের জন্য জনসাধারণকে তাঁহারা নানারূপ উপদেশ দিতেন। উপদেশকের আসল উদ্দেশ্য ছিল মানব জীবনের উৎকর্ষ সাধন। উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য তাহারা কখনও নানাবিধ কাল্পনিক কাহিনী বা উপাখ্যান রচনা করিয়া সাধারণকে শুনাইতেন, যাহার মধ্যে নিহিত থাকিত চরিত্র গঠন ও জাতীয় উন্নতির প্রেরণা। শুধু নিজেরাই বলিতেন না, বলাইতেন– জীব-জন্তু, দেব-দেবী বা ঈশ্বরকে দিয়াও। তাহারা মন্দ কাজের জন্য ভয় দেখাইতেন এবং ভালো কাজের জন্য অভয় দান করিতেন। তবে ভীতিকরগুলি পুকুরের কুমির ও বাগানের বাঘের মতো বসতবাড়ির কাছাকাছি থাকিত না, থাকিত বহুদূরে, মানুষের দৃষ্টিসীমার বাহিরে (পরকালে)।
মানুষের ব্যক্তিজীবনে এই অবস্থাটি প্রতিফলিত হয় ৫-৬ হইতে ১০-১১ বৎসর বয়সের মধ্যে এবং সমাজপতি বা উপদেশকের ভূমিকা গ্রহণ করেন পাঠশালা, মক্তব ও টোলের পাঠ্যপুস্তক প্রণেতাগণ এবং শিক্ষকবৃন্দ।
সভ্যতার কৈশোরাবস্থা –এই অবস্থায় সমাজপতিরা বনিয়াছেন রাজ্যপতি। মানবতাবিরোধী বা নীতিগর্হিত কাজের জন্য নানাবিধ হিতোপদেশ দান ও নরকবাসের ভয় দেখাইয়া ক্ষান্ত থাকিতেন না রাজ্যপতিরা সমাজপতিদের মতো, তাহারা ব্যবস্থা করিতেন কারাবাস, বেত্ৰদণ্ড ইত্যাদির। সমাজপতিদের আয়ত্তে ছিল শুধু ভাষণ ও তোষণ, কিন্তু রাষ্ট্রপতিরা করিতেন শাসন ও পোষণ।
সমাজপতি বা মান্ধাতার আমলের অতিপ্রাকৃতিক বা অলৌকিক কাহিনীগুলি এই সময়ে আর সকলে বিশ্বাস করিতে চাহিলেন না। কার্য-কারণ সম্পর্ককে ভিত্তি করিয়া গড়িয়া উঠিল দার্শনিক মতবাদ। ফলে দ্বন্দ্ব বাধিল বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী –এই দুই দলে।
সভ্যতা বিকাশের উপরোক্ত অবস্থাটি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে প্রভাব বিস্তার করে ১২-১৩ বৎসর বয়স হইতেই। উহার প্রকট রূপ দেখিতে পাওয়া যায় ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আধুনিক শিক্ষায়তনগুলিতে এবং অনেকটা বাহিরেও।
সভ্যতার যৌবনাবস্থা —এই অবস্থাটি হইল মানব সভ্যতার বর্তমান অবস্থা। ইহার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলা নিষ্প্রয়োজন। কেননা, জনসাধারণ ইহার প্রত্যক্ষদর্শী এবং প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে উহার বিবৃতি দেওয়া নিরর্থক।
এই সময়টিকে বলা হয় বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞান হইল মানবীয় জ্ঞানের পরিপক্ক অবস্থা এবং মানব সভ্যতার যৌবনাবস্থাও বটে। এই যুগে যুগমানবের আসনে সমাসীন বিজ্ঞানীরা, সমাজপতিরা নহেন। বিজ্ঞানীরা হইলেন নীরব সাধক। কোনো মতবাদ অটুট রাখিবার বা প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য বিজ্ঞানীরা কখনও কোনোরূপ হৈ-চৈ করেন না। বিশেষত কোনো মতবাদকে সামান্য আঘাতে ভাঙ্গিয়া যাওয়ার ভয়ে মুরগির ডিমের মতো পাখার নিচে পুঁজিয়া রাখেন না, উহা ছাড়িয়া দেন বিশ্বের দরবারে –সত্যমিথ্যা যাচাইয়ের জন্য।
এই যুগের প্রধান বৈশিষ্ট হইল –১. গতানুগতিকতা বর্জন করা, অর্থাৎ স্বয়ং কিছুই না বুঝিয়া অন্যের দেখাদেখি কোনো কাজ না করা; ২. কোনোরূপ আপ্তবাক্য গ্রহণ না করা, অর্থাৎ কোনো কথা সত্য কি মিথ্যা তাহা যাচাই না করিয়া শুধু গুরুবাক্য বলিয়া বা বক্তার নামের জোরেই বিশ্বাস না করা ইত্যাদি।
সভ্যতা বিকাশের উপরোক্ত অবস্থাটি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে প্রস্ফুটিত হয় যৌবনে। কেননা, এই সময়টিই মানুষের ব্যক্তিগত জ্ঞানের পরিপক্ক অবস্থা। কিন্তু কেহ যদি ৬০ বৎসর বয়সেও তাহার মুরুব্বিদের সেই শৈশবকালের উপদেশ মানিয়া চলেন, অর্থাৎ পুকুরে কুমির, বাগানে বাঘ, শ্মশানে ভূত ও গোরস্থানে শয়তান থাকে –ইহা বিশ্বাস করিয়া ঐসকল জায়গায় না যান, তবে তাহাকে কি বলা যায়? তাহাকে বলা যায়– ৬০ বৎসর বয়সের শিশু!
১৩. সভ্যতা বিকাশের কতিপয় ধাপ
সভ্যতা বিকাশের কতিপয় ধাপ
# অগ্নি আবিস্কার
আজকাল অগ্নি উৎপাদন করা আমাদের কাছে একান্তই খেলো। বিজ্ঞানের বদৌলতে রাসায়নিক ও বৈদ্যুতিক নানা উপায়ে অগ্নি উৎপাদন করা হইয়াছে একান্ত সহজ। একটি দেশলাই পকেটে ফেলিয়া উহা দ্বারা মুহুর্মুহু আমরা অগ্নি উৎপাদন করিয়া থাকি। কিন্তু আদিম মানবদের এইসকল সুযোগ-সুবিধা ছিল না। তখন অগ্নি উৎপাদন করা ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
অগ্নি দুই প্রকার –প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম।
প্রাকৃতিক অগ্নি
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, সূর্য একটি অগ্নিপিণ্ড এবং পৃথিবী উহারই একটি অংশ। আদিতে এই পৃথিবীটিও অগ্নিময় ছিল এবং উহা নির্বাপিত হইতে সময়.লাগিয়াছিল লক্ষ লক্ষ বৎসর। ভূপৃষ্ঠ এখন ঠাণ্ডা হইয়া জীববাসের যোগ্য হইয়াছে এবং নানা রকম জীব বাস করিতেছে। ভূপৃষ্ঠের কোথায়ও সেই আদিম অগ্নির নামগন্ধও নাই। তবে সেই আদিম অগ্নির বীজ এখনও সুপ্ত আছে পৃথিবীর কেন্দ্রপ্রদেশে এবং উহার সাক্ষাত পাই আমরা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময়ে। কিন্তু সেই অগ্নি মানুষের স্বার্থের অপেক্ষা অনর্থই ঘটায় বেশি।
এককালে পৃথিবীর অনেক জায়গাই ছিল ঘন বনে আবৃত। লোকবৃদ্ধির সাথে সাথে ভূপৃষ্ঠ ক্রমশ বনশূন্য হইতেছে। সেকালে কোনো কোনো সময় বনমধ্যে কাষ্ঠে কাষ্ঠে ঘর্ষণের ফলে হঠাৎ আগুন জ্বলিয়া উঠিত এবং তাহাতে বনকে-বন জ্বলিয়া ছারখার হইয়া যাইত ও বনের পশু পাখিরা জ্বলিয়া-পুড়িয়া মারা যাইত। উহাকে বলা হইত দাবানল। দাবানল এতই উগ্রমূর্তি ধারণ। করিত যে, মানুষ বা কোনো প্রাণীই উহার কাছে ঘেঁষিত না। মহাভারতে উক্ত আছে যে, ঐরূপ একটি দাবানলে ইন্দ্রপ্রস্থের নিকটস্থ খাণ্ডব বন দগ্ধ হইয়াছিল। খাণ্ডব অধুনা মধ্যপ্রদেশের নিমার জিলার প্রধান নগর। প্রবাদ আছে যে, ঐখানেই খাণ্ডবদাহ হইয়াছিল। সে যাহা হউক, দাবাগ্নি মানুষের কোনো উপকারে আসে না।