মৎস্য অবস্থা
মানুষের দৈহিক রূপের বিকাশ শুরু হয় এই মৎস্য অবস্থায়। মাছের মতো জলজীবন, মাছের মতো চেহারা এবং বহির্জগতের আলো-বাতাসের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ থাকে না মাছের মতোই। ইহা ব্যক্তিজীবনের প্রাথমিক অবস্থা, ইহার নাম শুক্রকীট।
সরীসৃপ অবস্থা
পশুদের মতো সরীসৃপরাও চারি পায়ের অধিকারী বটে, কিন্তু উহারা পায়ের দ্বারা পেট শূন্যে তুলিয়া রাখিতে পারে না, মাটিতে টানিয়া চলে। মানবশিশুরাও ৫-৬ মাস বয়স্ক হইলে উপুড় হইতে শুরু করে এবং ক্রমে কুমিরাদি সরীসৃপদের ন্যায় মাটিতে বুক টানিয়া চলিতে থাকে। এই অবস্থাকে বলা হয় শিশুর বুকে চলা বা বুকে হাঁটা।
পশু অবস্থা
পশুরা চারি পায়ে হাঁটে। বিজ্ঞানীদের মতে, মানুষও কোনো এক সময়ে পশু পর্যায়ে ছিল এবং চারি পায়ে হাঁটিত। ঐ অবস্থাটি ব্যক্তিজীবনে প্রতিফলিত হয় শৈশবে। ন্যূনাধিক ৯-১০ মাস বয়স্ক শিশুরা হামাগুড়ি দিয়া চলিতে আরম্ভ করে। ইহাতে শিশুরা চলিবার জন্য হাত ও পা সমানে ব্যবহার করে পশুদের মতোই।
অর্ধমানব অবস্থা
মানুষের পূর্বপুরুষেরা পুরাপুরি দ্বিপদ হইবার আগে গরিলা, শিম্পাঞ্জি ও বানরাদির ন্যায় কখনও দুই পায়ে এবং কখনও চারি পায়ে হাঁটিত এবং চলিবার সময় দেহ সামনের দিকে ঝুঁকিয়া থাকিত। সদ্য হাঁটিতে শেখা শিশুরাও ঐরূপ কখনও হাঁটে, আবার কখনও হামাগুড়ি দেয় এবং ঐ অবস্থায় কোনো শিশুই সোজা হইয়া হুঁটিতে পারে না।
অসভ্য অবস্থা
মানুষ যখন পুরাপুরি দ্বিপদ জীব অর্থাৎ মানুষ নামের অধিকারী হইয়াছিল, তখন তাহারা ছিল বুনো বা অসভ্য মানুষ। তখন তাহারা খাইবার মতো যাহা পাইত, তাহা দিয়াই উদর পুরাইত; ক্ষুধানিবৃত্তিই ছিল খাইবার উদ্দেশ্য। তাহারা উলঙ্গ থাকিত, বনে বনে ঘুরিয়া পশু-পাখি মারিত ও উহা কাঁচা ভক্ষণ করিত। বৃক্ষকোটরে বা পর্বতগুহায় বাস করিত। তুচ্ছ বিষয় লইয়া কলহ করিত, আবার পরমুহূর্তে উহা ভুলিয়া যাইত। তাহারা ছিল অকপট, নিরলস, স্বেচ্ছাচারী ও নোংরা। বলা। বাহুল্য, ঐরূপ অসভ্য বা অনুন্নত মানবগোষ্ঠী আজিও দুনিয়ার কোনো কোনো অঞ্চলে দেখিতে পাওয়া যায়।
মানবশিশুদের মধ্যে উক্তরূপে এমন একটি অবস্থা আসিয়া থাকে, যখন তাহারা সাধারণত খাদ্যাখাদ্য যাহা হাতের কাছে পায়, তাহাই তুলিয়া মুখে দেয়, মাতা-পিতার সঙ্গেও ‘তুই’ শব্দটি ব্যবহার করে, ধুলা-বালি লইয়া খেলিতে ও ময়লা গায়ে থাকিতে চায়, উলঙ্গ থাকিতে লজ্জাবোধ করে না ইত্যাদি অসভ্যজনোচিত আচরণ করিয়া থাকে। অসভ্যদের মতোই শিশুরা অকপট, সত্যবাদী, নিরলস, নোংরা এবং স্বেচ্ছাচারী হইয়া থাকে। শিশুদের তুচ্ছ বিষয় লইয়া সাথীদের সাথে বকাবকি, মারামারি, আবার নিমেষে মিলিয়া-মিশিয়া খেলা করা, ঢিল ছোঁড়া, পাখি ধরা, গাছে উঠা ইত্যাদির প্রবণতা সেই আদিম অসভ্য মানবদের চরিত্রেরই ছায়া।
সভ্য অবস্থা
মানব সভ্যতার প্রধানত চারিটি ধাপ। যথা –শৈশব, বাল্য, কৈশোর ও যৌবনাবস্থা।
সভ্যতার শৈশবাবস্থা –সভ্য জগত ও অসভ্য জগতের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা নাই। সভ্যতা আসিয়াছে যুগ যুগ ধরিয়া, হাজার হাজার বৎসরে, ক্রমে ক্রমে। কিন্তু আজিও কি আমাদের সমাজে পূর্ণ সভ্যতা আসিয়াছে? আজিও সভ্যতার দাবিদারদের সমাজে রমণীদের অগচ্ছেদনপূর্বক অলকার পরানো, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, মহামারী ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিবারণের জন্য দেবতাদের কাছে ধর্ণা দেওয়া ইত্যাদি যে সকল রীতি-নীতি প্রচলিত আছে, (প্রিয় পাঠক রাগ করিবেন না) ঐগুলি সবই অসভ্য যুগের প্রথা। পক্ষান্তরে সভ্যজনোচিত কোনো কোনো প্রথা অসভ্য যুগেও ছিল। যেমন –মাতা-পিতা বা বংশপ্রধানকে মান্য করা ইত্যাদি।
শেষোক্ত নীতিটির উপর ভিত্তি করিয়াই অসভ্য মানব যুগে যুগে পা বাড়াইয়াছিল সভ্যতার দিকে। পিতৃপ্রধান হইতে উদ্ভব হইয়াছে গোষ্ঠীপ্রধানের যুগ, অতঃপর সমাজপতি বা মোড়ল প্রধানের যুগ ও পরে রাষ্ট্রপ্রধান বা রাজা-বাদশাহের যুগ। সে যাহা হউক, মানব সভ্যতার শৈশবে পিতৃপ্রধান যুগই ছিল। সন্তানেরা মাতা-পিতার আহার-বিহার, চাল-চলন অনুসরণ করিত; তাহাদের যে কোনো বাক্য অভ্রান্ত বলিয়া বিশ্বাস করিত। বস্তুত পিতা-মাতাই ছিল সেকালের মানুষের শিক্ষাগুরু।
মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে ঐ অবস্থাটি প্রতিফলিত হয় তিন-চারি বৎসর বয়সে। অধিকাংশ শিশুরই এই বয়সের সকল কথা বা ঘটনা স্মরণ থাকে না, কিন্তু নিজ্ঞান মনে (Unconscious Mind) উহার দাগ থাকে। মনোবিজ্ঞানীগণ বলেন যে, শিশুদের ভাবী জীবনে চরিত্র গঠনের ভিত্তিপত্তন বা উপাদান সংগ্রহ হয় এই সময় হইতেই। এই অবস্থার প্রথম দিক দিয়া শিশুরা হয় গতানুগতিকপন্থী, অনুকরণপ্রিয় এবং সরল বিশ্বাসী। মাতা-পিতা, গুরুজন বা সহগামীদের চাল চলন, আহার-বিহার ইত্যাদি অনুসরণ করিয়া চলে এবং উহাদের যে কোনো বচন অভ্রান্ত বলিয়া বিশ্বাস করে।
হয়তো কোনো শিশুর মা-বাবা জলডুবি হইবার বা পোকা-মাকড় ও সাপে কামড়াইবার ভয়ে শিশুকে বলিল, পুকুরে কুমির বা বাগানে বাঘ আছে। হয়তো শিয়াল-কুকুরে কামড়াইবার ভয়ে কোনো শিশুকে বলা হইল, “শ্মশানে ভূত ও গোরস্থানে শয়তান থাকে, উহারা শিশুদের পাইলে ঘাড় মটকায়, ঐসব জায়গায় কখনও যাইবে না” ইত্যাদি। যদিও এই জাতীয় উপদেশগুলির উদ্দেশ্য মহৎ, কিন্তু কুমির, বাঘ, ভূত ও শয়তান সবই মিথ্যা। তথাপি সরলমতি শিশু উহা সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিল এবং উপদেশগুলি পালনের সুফলও লাভ করিল। এই কথা সত্য যে, তখন ঐ উপদেশগুলি বিশ্বাসপূর্বক পালন না করিলে হয়তো শিশুরা মহাবিপদে পতিত হইত।