আমাদের দেশের বর্তমান সরকার পরিবার পরিকল্পনা বনাম জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন এবং এই ব্যাপারে সর্বাত্মক সাফল্য লাভের জন্য দেশের প্রায় সর্বত্র উহার যথাবিহিত ব্যবস্থা গৃহীত হইয়াছে ও হইতেছে। আশা করি বিধাতা বর্তমান দুনিয়ার মানুষের দুই সন্তান’-এর প্রার্থনা অচিরেই মঞ্জুর করিবেন।
————
[২৭. প্রাণতত্ত্ব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃ. ১০৭, ১০৮।
২৮. ঐতিহাসিক অভিধান, মো. মতিয়র রহমান, পৃ. ২৩, ২৪।]
১২. সভ্যতার বিকাশ
সভ্যতার বিকাশ
# হাতিয়ারের ক্রমোন্নতি
মানব জাতির ক্রমোন্নতির মূলে রহিয়াছে হাতিয়ারের ক্রমোন্নতি। আদিম মানবের জীবনে একটিমাত্র সমস্যা ছিল, তাহা হইল আত্মরক্ষা। সুখেই হউক আর দুঃখেই হউক, বাঁচিয়া থাকাই ছিল তাহাদের প্রধান সমস্যা। বাঁচিয়া থাকিতে হইলে প্রথমত চাই খাদ্য ও শত্রুর কবল হইতে মুক্তি। খাদ্যসংস্থানে ঝামেলা থাকিলেও উহা তত মারাত্মক নহে। কেননা, বনে বনে ঘুরিয়া ফলমূল সংগ্রহ বা ছোট ছোট জানোয়ার হত্যা করিয়া তাহার কাঁচা মাংস ভক্ষণ করা একেবারে অসাধ্য ছিল না। হয়তো দুই-এক বেলা অনাহারে থাকিলেও তাহাতে মৃত্যুভয় নাই। শীতাতপ হইতে রক্ষা পাইতে হইলে কোনো রকমে কায়ক্লেশে গাছের কোটরে বা পাহাড়ের গুহায়। প্রবেশ করিতে পারিলেই ব্যাস। কিন্তু বাঘ-ভালুকাদি হিংস্র জানোয়ারের আক্রমণ হইতে রক্ষা পাওয়াই ছিল কঠিন কাজ। শত্রুর কবল হইতে আত্মরক্ষার উপযোগী কোনো ব্যবস্থাই ছিল না মানুষের গায়ে, যেরূপ ছিল পশু-পাখিদের। বাঘের মতো বিরাট দেহ বা দাঁত-নখরও ছিল না, আর গরু-মহিষের মতো শিংও ছিল না। সম্বল ছিল মাত্র দুইখানা হাত। তাহাও বেশি বড় নহে এবং উহাতে শক্তিই বা কতটুকু! তাই আদিম মানব সাহায্য লইল হাতিয়ারের। সেই হাতিয়ার আর কিছুই নহে –গাছের ডাল ও পাথরের টুকরা।
বন্য জানোয়ারের আক্রমণ সাধারণত আঁচড়ানো ও কামড়ানো। কিন্তু একেবারে গায়ে পড়া শত্রু না হইলে এ ধরণের আক্রমণ চলে না। আদিম মানবেরা যখন দৃঢ় মুষ্টিতে গাছের ডাল ধরিয়া দলবদ্ধভাবে আক্রমণ চালাইত, তখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জানোয়ার মারা পড়িয়া উহাদের খাবার তো জোগাড় হইতই, বরং অনেক হিংস্র জন্তু লড়াইয়ে হার মানিত। কেননা, ইহাতে আক্রমণকারীরা থাকিয়া যাইত হিংস্র জন্তুদের নাগালের বাহিরে।
আদিম মানব শিকার ও আত্মরক্ষার কাজে প্রধানত গাছের ডাল বা লাঠিই ব্যবহার করিত। অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সাথে সাথে যখন বুঝা গেল যে, কঠিন কোনো কিছু খুঁড়িয়া মারিলে আরও দূর হইতে আক্রমণ চালানো যায়, তখন উহারা ঐ কাজে ব্যবহার করিতে আরম্ভ করিল পাথরের টুকরা –যে রূপে পাওয়া যাইত সেই রূপেই। যখন দেখা গেল যে, পাথরের টুকরাগুলি ধারালো সূঁচালো হইলে শত্রুকে ঘায়েল করা যায় আরও সহজে, তখন উহারই চেষ্টা চলিতে লাগিল। এইভাবে কালক্রমে সৃষ্টি হইল আদিম মানবদের নানা ধরণের পাথরের হাতিয়ারের।
ক্রমে দেখা গেল যে, ঘুড়িয়া মারা হাতিয়ার সব সময়ে লক্ষ্যস্থলে পড়ে না। তাই অনেক সময়েই শিকার ফসকাইয়া যায়। চেষ্টা চলিল অব্যর্থ আঘাত হানিবার হাতিয়ার তৈয়ারের। একখণ্ড কাঠের দণ্ডে পাথরের ফলা যুক্ত করিয়া তৈয়ার করা হইল বর্শা, বল্লম, ক্রমে উড়ন্ত বর্শা।
উড়ন্ত বর্শাও হাতে ছোঁড়া হইত। কাজেই উহার গতিবেগ ও পাল্লা তত বেশি নহে। উড়ন্ত বর্শাই ক্রমে রূপ পাইল তীর-ধনুকের। মানব সভ্যতার এক বিরাট সাফল্য এই তীর-ধনুকের আবিষ্কার। আদিতে ইহার ব্যবহার ছিল পশু-পাখি শিকার ও আত্মরক্ষামূলক কাজেই এবং উহার ব্যবহার চলিয়াছিল হাজার হাজার বৎসর। সভ্যতাবৃদ্ধির সাথে সাথে তাম্র ও লৌহ আবিষ্কারের পর তীর-ধনুকের উন্নতি হইয়াছিল অসাধারণ। কিন্তু উন্নতি হইলে কি হইবে, উহা দ্বারা পশু পাখি হত্যার বদলে আরম্ভ হইয়াছিল নরহত্যা এবং পশু-পাখির স্থলাভিষিক্ত হইয়াছিল রামানুজ লক্ষ্মণ, লঙ্কেশ্বর রাবণ ও নূরনবীর দৌহিত্র ইমাম হোসেনও।
আধুনিক যুগে আবার তীর-ধনুকের চেহারা বদল হইয়া উহার তীরটি হইয়াছে গোল এবং ধনুটি হইয়াছে সোজা –সৃষ্টি হইয়াছে বন্দুক, কামান ইত্যাদি মারণাস্ত্রের। শেষমেশ পারমাণবিক বোমা।
হাতিয়ার শুধু মারণাস্ত্রই নহে। যাহা হাতের বদলে ব্যবহৃত হয় বা হাতের শক্তি বাড়াইয়া দেয়, তাহাই হাতিয়ার শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। মানুষের সমাজ জীবনে, বিশেষত শিল্প, কৃষি, চিকিৎসা বিজ্ঞান ইত্যাদিতে রকমারি হাতিয়ার বনাম কল কারখানার অন্ত নাই। অধুনা মানব সভ্যতার মাপকাঠিই হইল হাতিয়ার। যে জাতির হাতিয়ার যত উন্নত, সেই জাতি সভ্যতায় তত অগ্রগামী।
.
# জাতিগত জীবন ও ব্যক্তিজীবনে সাদৃশ্য
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, ক্রমবিবর্তনের নিয়ম মতে মানুষ তাহার জাতিগত জীবনে যে যে অবস্থাপ্রাপ্ত হইয়া বর্তমান অবস্থায় পৌঁছিয়াছে, তাহার প্রত্যেকটি অবস্থা মূর্ত হইয়া উঠে তাহার ব্যক্তিজীবনে। মনুষ্য জাতির বিবর্তনের প্রধান প্রধান স্তর বা অবস্থা হইল –১. মৎস্য, ২. সরীসৃপ, ৩. পশু, ৪. অর্ধমানব, ৫. অসভ্য মানব ও ৬. সভ্য মানব ইত্যাদি। মানব সভ্যতার আবার কয়েকটি সুস্পষ্ট ধাপ আছে। যথা –পুরাতন পাথর যুগ, নূতন পাথর যুগ, তাম্র যুগ, লৌহ যুগ ইত্যাদি। ইহাকে আমরা বলিতে পারি মানব সভ্যতার –শৈশব, বাল্য, কৈশোর ও যৌবন অবস্থা। এই সমস্ত অবস্থা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে কি রকম প্রতিফলিত হইতেছে, এইখানে আমরা তাহার কিছু আলোচনা করিব।