মনে হয় যে, কৃত্রিম প্রজননে সবচেয়ে বেশি উৎকর্ষ সাধিত হইয়াছে উদ্ভিদ বিশেষত কৃষিবিজ্ঞানে। প্রতি বৎসর নূতন নূতন ধরণের বহু জাতের ফুল-ফলের গাছ উৎপন্ন করিয়া আমাদের উপহার দিতেছেন নার্সারিওয়ালারা। ধান, পাট, আখ, গম ইত্যাদি ফসল, লাউ, কুমড়া ইত্যাদি তরিতরকারি এবং আম, কাঁঠাল, কলা, নারিকেল ইত্যাদি যে সকল উন্নত মানের গাছ গাছড়া এযাবত উদ্ভিদবিজ্ঞানীগণ কৃত্রিম প্রজনন দ্বারা উৎপন্ন করিতে সমর্থ হইয়াছেন, কৃষকগণ তাহার যথাযথ ব্যবহার করিলে দেশের খাদ্যাভাব ও অর্থাভাব দূর হইবে, এইরূপ আশা করা যায়।
কৃত্রিম প্রজননের ফলে গৃহপালিত পশু-পাখিদেরও উৎকর্য হইয়াছে ও হইতেছে প্রচুর। ঐসমস্তের প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় হাঁস-মোরগ ও গবাদি পশুর সর্বাধুনিক খামারগুলি দর্শনে। এখন বিজ্ঞানীগণ কৃত্রিম প্রজননের অভিযান চালাইতেছেন মৎস্যরাজ্যেও এবং সেখান হইতেও কানে আসিতেছে তাহাদের বিজয়ডঙ্কার শব্দ।
কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে মানুষের কৌলিক ব্যাধি ও অন্যান্য দোষ-ত্রুটি সংশোধনপূর্বক কি রকম মনুষ্য সমাজের সর্বাঙ্গীন উন্নতি সাধিত হইতে পারে, সেই বিষয়ে গবেষণা করিবার জন্য বিজ্ঞানের একটি নূতন শাখার সৃষ্টি হইয়াছে, যাহার নাম সুজননবিদ্যা (Eugenics)।
.
# জন্মশাসন
জগতের সব কিছুই পরিবর্তনশীল, এমনকি স্বয়ং জগতটিও তদ্রূপ। তবুও একশ্রেণীর মানুষ। “বিধাতার বিধান অপরিবর্তনীয়” –ইহা বলিয়া জগতের বহু বিষয়কে অপরিবর্তনীয় রূপে ধরিয়া রাখিতে সতত চেষ্টা করে। কিন্তু বিধাতার (প্রকৃতির) বিধানবশতই তাহা অসম্ভব হইয়া পড়ে। বিধাতার অনেক আশীর্বাদ বর্তমানে অভিশাপে পরিণত হইয়াছে। উহার মধ্যে একটি হইল মানুষের বংশবৃদ্ধি।
বংশবৃদ্ধি অর্থাৎ সন্তান-সন্ততি হওয়া নাকি বিধাতার একটি মস্ত বড় আশীর্বাদ। পূর্বে বলা হইত এবং এখনও কেহ কেহ বলিয়া থাকেন যে, যে ব্যক্তির সন্তান-সন্ততির সংখ্যা যত অধিক, সে তত অধিক আশীর্বাদপ্রাপ্ত অর্থাৎ ভাগ্যবান। বিধাতার আশীর্বাদের ফলেই নাকি রাবণের লক্ষ পুত্র, ধৃতরাষ্ট্রের শত পুত্র এবং হজরত আদমের পুত্রকন্যার সংখ্যা নাকি একশত বিশ। যদিও এই যুগে ঐরূপ ঢালাও আশীর্বাদ পৃথিবীর কোথায়ও দেখা যায় না, তথাপি এক দম্পতির দশ-বিশটি সন্তান প্রাপ্তির আশীর্বাদ বিরল নহে। পূর্বে মানুষের বহু সন্তান কাম্যও ছিল। কোনো নববধূকে আশীর্বাদ করিয়া বলা হইত, “তুমি সাত পুতের মা হও”। আর আজ? এক জোড়ার অধিক সন্তান কাহারও কাম্য নহে।
উপরোক্ত আশীর্বাদের ফলে বর্তমানে জগতে ঘটিয়াছে খাদ্যের অভাব ও ঘটিতেছে অনাহারে মানুষের মৃত্যু। আমাদের এই সোনার বাংলাদেশে অনাহারে যাহারা মারা গিয়াছে, তাহাদের সংখ্যা হয়তো হাজার হাজার। কিন্তু তিলে তিলে মৃতের সংখ্যা লক্ষ লক্ষও নহে, কোটি কোটি।
বহু সন্তানের আশীর্বাদের কবল হইতে মানব জাতিকে উদ্ধার করিবার মানসে বর্তমান জগতের জননায়কগণ অধুনা প্রবর্তন করিয়াছেন জন্মশাসন, যাহার প্রচলিত নাম হইল পরিবার পরিকল্পনা বা জন্মনিয়ন্ত্রণ। আর রাষ্ট্রনেতাগণ এই কাজটি সাফল্যমণ্ডিত করিবার ভার অর্পণ করিয়াছেন জীববিজ্ঞানীদের উপর।
বর্তমান জগতের কোনো বিবেকবান ব্যক্তিই জন্ম, মৃত্যু, খাদ্য, সম্পদ ইত্যাদি বিষয়ের দায়-দায়িত্ব বিধাতার মাথায় চাপাইয়া দিয়া নিজে আরামে বসিয়া থাকিতে ইচ্ছুক নহেন। বিশেষত বিজ্ঞানীগণই ইহাতে অগ্রগামী। যদিও পরিবার পরিকল্পনা আন্দোলনের বয়স খুবই অল্প, তথাপি বিজ্ঞানীগণ জন্মনিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে নানাবিধ গবেষণা চালাইয়া উহার জন্য অনেকগুলি উপায় আবিষ্কার করিয়াছেন এবং উহা অবলম্বনে আশানুরূপ ফললাভ হইতেছে।
জন্মনিয়ন্ত্রণ যৌনক্রিয়ানিয়ন্ত্রণ নহে; উহা হইল নারী-পুরুষের সন্তানোৎপাদিকা শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা। নারী ও পুরুষের মিলনের ফলেই সন্তানোৎপাদিত হয় না, উহা হয় শুক্রকীট ও ডিম্বকোষের মিলনের ফলে। তাই নারী ও পুরুষের মিলন অব্যাহত রাখিয়া শুধু শুক্রকীট ও ডিম্বকোষের মিলন ব্যাহত করাই জন্মনিয়ন্ত্রণের মুখ্য প্রক্রিয়া। আর এই কাজের জন্য প্রধানত দুইটি পদ্ধতি অবলম্বন করা হইয়া থাকে। প্রথম পদ্ধতি হইল রতিকালে নানা কৌশলে শুক্রকীট ও ডিম্বকোষের মিলনে বাধাদান করা এবং দ্বিতীয় পদ্ধতি হইল নারী ও পুরুষের ডিম্বাধার ও শুক্ৰাধারে ডিম্বকোষ ও শুক্রকীট জন্মিতে না দেওয়া। আর যদি ইহার একটিও কার্যকর না করা যায়, তবে চরম পদ্ধতি হইল ভূণ নষ্ট করা। কিন্তু ইহা অনভিপ্রেত। প্রথমোক্ত পদ্ধতি দুইটি অনুসারে বিজ্ঞানীগণ এযাবত বহু কৌশল আবিষ্কার করিয়াছেন ও করিতেছেন। তাহার মধ্যে এইখানে কয়েকটি কৌশলের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হইল।
১. পিচকারি বা ডুশ প্রয়োগ –রতিক্রিয়ার অব্যবহিত পরেই শুধু জল অথবা সাবান-জল, কুইনাইনের জল, রজার্স পাউডারের জল, লেবুর রস বা ভিনিগার মিশ্রিত জলের পিচকারি বা ডুশ প্রয়োগে স্ত্রীঅঙ্গ ধৌত করিলে গর্ভসঞ্চারের সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু পুরুষের রেতপাতের সঙ্গে সঙ্গে যদি উহা জরায়ুতে প্রবেশ করিয়া থাকে, তবে এই পদ্ধতি কার্যকর নাও হইতে পারে। ডুশের বহুবিধ প্রয়োগরূপ আছে।