মেণ্ডেল (Mendel) ছিলেন অস্ট্রিয়ার এক ক্ষুদ্র শহরের খ্রীস্টানী মঠের একজন পাদ্রী (খ্রীস্টানগণ বিশেষত পাদ্রীগণ ভগবানকে পিতা ও নিজেদেরকে তাহার পুত্র বলিয়া থাকেন)। তিনি লক্ষ্য করিয়াছিলেন যে, একই জাতের ফুল ও ফলের বীজ হইতে নানা ধরণের ফুল ও ফল উৎপন্ন হইয়া থাকে। যেমন– একটি লম্বা জাতের লাউয়ের বীজ হইতে লম্বা, গোল ও মাঝারি ধরণের লাউ জন্সিতে দেখা যায়, একটি আম্রবৃক্ষের বীজ হইতে বিভিন্ন ধরণের আম্রফল ফলিয়া থাকে, যাহাদের স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণ হয় ভিন্ন ভিন্ন এবং কোনো মানুষও সর্ববিষয়ে তাহার মাতা ও পিতার অনুরূপ হয় না ইত্যাদি। তাই তিনি ভাবিতেছিলেন যে, প্রকৃতির এইসব খেয়ালিপনা কেন, এই সবের সাথে উহাদের যৌন প্রক্রিয়ার কোনো সম্পর্ক আছে কি না।
তিনি তাহার বাগানে কয়েকটি কড়াইশুটির গাছ লইয়া পরীক্ষা শুরু করিলেন। উহার কোনোটির লতা লম্বা, কোনোটির খাটো; কোনোটির খুঁটি পাকিলে হলুদ রং ধারণ করে, কোনোটি থাকে সবুজ; উহাদের ফুলের রংও ভিন্ন ভিন্ন। তিনি লম্বা জাতের সঙ্গে খাটো জাতের মিশ্রণ ঘটাইয়া প্রথম পরীক্ষা শুরু করিলেন এবং লম্বা জাতের ফুলের পরাগ লইয়া খাটো জাতের ফুলের বীজকোষে লাগাইয়া দিলেন। উহাতে যে ফল উৎপন্ন হইল এবং সেই ফল হইতে যে বীজ জন্সিল, তাহা বপন করিয়া দেখিলেন যে, পরের (দ্বিতীয়) বৎসর সকল চারাই হইল লম্বা জাতের। ইহাদের বীজ পুনঃ বপন করিলে তৃতীয় বৎসরে দেখা গেল যে, উহাদের ৩/৪ ভাগ লম্বা ও ১/৪ ভাগ খাটো গাছ জন্মিল। চতুর্থ বৎসরে উহাদের বীজ পুনঃ বপন করিলে দেখা গেল যে, খাটো গাছের বীজ হইতে শুধু খাটো গাছই জমিল, কিন্তু লম্বা গাছের বীজ হইতে জন্মিল পুনরায় তিন ভাগ লম্বা ও এক ভাগ খাটো। অতঃপর তিনি কড়াইশুটির অন্যান্য গুণ যথা –শুটির রং, ফুলের রং ইত্যাদি লইয়া পরীক্ষা করিয়াও ফল পাইলেন ঠিক একই রকম। তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, জীবের গুণগত বৈচিত্রগুলি সবই যৌনঘটিত ব্যাপার।
মেণ্ডেল সাহেবের পথ অনুসরণ করিয়া দেখা গিয়াছে যে, কালো বর্ণের গাভীর সহিত কালো বর্ণের ষাঁড়ের মিলন ঘটাইলে সবগুলি বাচ্চাই কালো বর্ণের হইয়া থাকে এবং কালো বর্ণের গাভীর সহিত শাদা বা অন্য কোনো বর্ণের ষাঁড়ের মিলনের ফলে জন্মে দোআঁশলা বাছুর। লাল, কালো ও শাদা বর্ণের গাভীর সহিত লাল, কালো ও শাদা বর্ণের ষাঁড়ের মিলন ঘটাইলে তাহার ফল দাঁড়ায় এইরূপ —
লাল ষাঁড় কালো ষাঁড় শাদা ষাঁড়
লাল গাভীর বাছুর= লা২ লা-কা লা-শা
কালো গাভীর বাছুর = কা-লা কা২ কা-শা
শাদা গাভীর বাছুর = শা-লা শা-কা শা২*
[* প্রাণতত্ত্ব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃ. ১১৬।]
উপরোক্ত হিসাবে দেখা যায় যে, নয়টি বাছুরের মধ্যে লা২, কা২, শা২ –এই তিনটি বাছুর তাহাদের মাতা ও পিতার নিকট হইতে একই বর্ণ (গুণ) প্রাপ্ত হইয়াছে বলিয়া উহারা একই বর্ণ লাভ করিয়াছে এবং অবশিষ্ট ছয়টি দুই বর্ণ লাভ করিয়াছে বলিয়া হইয়াছে দোআঁশলা।
মানুষের উপরেও মেণ্ডেলিয়ান বংশানুক্রমের নিয়ম সমভাবে প্রযোজ্য। ও বাবা উভয়ের যদি কটা চক্ষু থাকে, তাহা হইলে তাহাদের সব ছেলে-মেয়ের কটা চক্ষু হইবে। কিন্তু মা-বাবার যদি কালো চক্ষু থাকে, তবে অধিকাংশ ছেলে-মেয়ের কালো চক্ষু হইলেও কৃচিৎ কটা চক্ষুও হইতে পারে। এইখানে চক্ষু ও চুল সম্বন্ধে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া গেল–
চোখ ও চুলের বৈশিষ্ট অনুসারে মানুষের বংশানুক্রম
জনক জননী সন্তান।
১. কালো চোখ কোঁকড়া চুল x কালো চোখ কোঁকড়া চুল = সব ঐ অথবা ১/৪ কটা চোখ;
১/৪ সোজা চুল।
২. ,, ,, x ,, সোজা চুল = সব কালো চোখ (১/৪ কটাও হইতে পারে);
সব কিংবা অর্ধেক সোজা চুল।
৩. ,, সোজা চুল x ,, ,, = সব কালো চোখ (১/৪ কটাও হইতে পারে);
সব সোজা চুল।
৪. কালো চোখ কোঁকড়া চুল x কটা চোখ কোঁকড়া চুল = সব কিংবা অর্ধেক কালো চোখ; সব
কিংবা ৩/৪ কোঁকড়া চুল। ৫. ,, ,, x ,, সোজা চুল = সব কিংবা অর্ধেক কালো চোখ; সব
কিংবা অর্ধেক কোঁকড়া চুল
৬. ,, সোজা চুল x ,, ,, = সব কিংবা অর্ধেক কালো চোখ; সব
সোজা চুল।
৭. কটা চোখ কোঁকড়া চুল x ,, কোঁকড়া চুল = সব কটা চোখ; সব কিংবা ৩/৪ কোঁকড়া চুল।
৮. ,, ,, x ,, সোজা চুল = সব কটা চোখ; সব কিংবা ১/২ কোঁকড়া চুল।
৯. ,, সোজা চুল x ,, ,, = সব কটা চোখ; সব সোজা চুল।*
[* প্রাণতত্ত্ব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃ. ১২৩।]
সাম্প্রতিক কালের জীব ও উদ্ভিদ বিজ্ঞানীগণ মেণ্ডেলিজমের ভিত্তিতে গবেষণা চালাইয়া বংশানুক্রম সম্বন্ধে এক নূতন যুগের সূচনা করিয়াছেন। অণুবীক্ষণাদি যন্ত্রের যতই উন্নতি সাধিত হইতেছে, বিজ্ঞানীগণ ততই ক্রোমোসোমের অভ্যন্তরস্থ সূক্ষাতিসূক্ষ্ম অণু-কণা সম্বন্ধে নব নব তত্ত্ব অবগত হইতেছেন। মেণ্ডেল সাহেব না জানিলেও আধুনিক বিজ্ঞানীগণ জানিতে পারিয়াছেন যে, জীবের বংশানুক্রমে যে কোনোও গুণের জন্য জীনগণই দায়ী। তাই বিজ্ঞানীগণ নানা উপায়ে জীনগণের অবস্থান্তর ঘটাইয়া ঈঙ্গিত গুণসমূহের উৎকর্ষ সাধনে সচেষ্ট হইয়াছেন এবং উহাতে তাহারা সাফল্য অর্জন করিয়াছেন যথেষ্ট।