ঐতরেয় উপনিষদ (১/১-২; ১/৩/১১) — “সষ্টির আদিতে একমাত্র আত্মাই বিদ্যমান ছিলেন, তিনি ভিন্ন আর কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না। তিনি সংকল্প করেন, আমি জগত সৃষ্টি করিব। তদনুসারে তিনি ভূলোক, দ্যুলোক, রসাতল, সমুদ, আকাশ, মৃত্তিকা, জল প্রভৃতি সৃষ্টি করেন। … তখন তিনি চিন্তা করেন, কি করিয়া উহার মধ্যে প্রবেশ করিবেন। এইরূপ চিন্তার পর তিনি শীর্ষ বিদীর্ণ করিয়া সকলের মধ্যে প্রবেশ করেন।”
মনু সংহিতা (১; ৬) –“প্রলয়ান্তে বহিরিন্দ্রিয়ের অগোচর অব্যাহত সৃষ্টিসামর্থ সম্পন্ন ও প্রকৃতি প্রেরক পরমেশ্বর স্বেচ্ছাকৃত দেহধারী হইয়া এই আকাশাদি, পঞ্চভূত ও মহদাদি তত্ত্ব, যাহা প্রলয়কালে সূক্ষরূপে অব্যক্তাবস্থায় ছিল, সেই সমুদয় স্থলরূপে প্রকাশকরত আপনিই প্রকাশিত হইলেন।”
এই বর্ণনাটি আধুনিক নীহারিকাবাদ-এর সহিত বহুলাংশে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
মনু (১; ৮) –“সেই পরমাত্মা প্রকৃতিরূপে পরিণত আপন শরীর হইতে নানা প্রকার প্রজা সৃষ্টি করিবার অভিলাষে, কিরূপে সৃষ্টি সম্পাদন হইবে, এই সঙ্কল্প করিয়া, প্রথমত ‘জল হউক’ বলিয়া আকাশাদিক্রমে জলের সৃষ্টি করিলেন ও তাহাতে আপন শক্তিরূপ বীজ অর্পণ করিলেন।”
মনু (১; ৯)— “অর্পিত বীজ সুবর্ণনির্মিতের ন্যায় ও সূর্যসদৃশ প্রভাযুক্ত একটি অণ্ড হইল। ঐ অণ্ডে সকল লোকের জনক স্বয়ং ব্রহ্মই শরীর পরিগ্রহ করিলেন।”
এইখানে বলা হইতেছে যে, জলে অর্পিত শক্তির বীজ হইতে সুবর্ণের ন্যায় বর্ণ ও সূর্যের ন্যায় প্রভাযুক্ত একটি ডিম্বাকার পদার্থের সৃষ্টি হইল, যাহার অভ্যন্তরে নিহিত থাকিলেন সকল সৃষ্টির জনক স্বয়ং ব্রহ্মা। ব্রহ্ম’ মানে তেজ বা অগ্নি। ইহাতে মনে হয় যে, উক্ত ডিম্বটি সূর্য ভিন্ন আর কিছুই নহে। বর্তমানে প্রমাণিত হইয়াছে যে, সূর্য একটি অগ্নিপিণ্ড এবং গ্রহাদির জনক ও পৃথিবীস্থিত জৈবাজৈব যাবতীয় পদার্থের সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু জল হইতে সূর্যের উৎপত্তি সম্ভব নহে।
মনু (১; ১২)– “ভগবান ব্রহ্মা সেই অণ্ডে ব্রাহ্ম পরিমাণে এক বৎসরকাল বাস করিয়া, ‘ দ্বিধা হউক’ মনে হইবামাত্র সেই অণ্ডকে দুই খণ্ড করিলেন।”
সেই ব্রহ্ম-অণ্ডটি (সূর্য) খণ্ডিত হইয়া পৃথিবীর জন্ম হইয়াছে –ইহা আধুনিক বিজ্ঞানীগণও বলেন, কিন্তু দুই খণ্ড বলেন না, বলেন দ্বাদশ খণ্ড। যথা –বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন, প্লুটো, ভালকান, পসিডন ও স্বয়ং রবিদেব। আর রবিদেব তাহার এক বৎসর বয়সের সময়ে খণ্ডিত হয় নাই, হইয়াছে কোটি কোটি বৎসর বয়সের সময়ে।
মনু (১; ১৩)– “তিনি দুই খণ্ডের উৰ্ব খণ্ডে স্বর্গ ও অপর খণ্ডে পৃথিবী করিলেন” (কোনো কোনো অসভ্য জাতিও এই মতটি পোষণ করে) এবং মধ্যভাগে আকাশ, অষ্ট দিক ও চিরস্থায়ী সমুদ্র নামক জলাধার প্রস্তুত করিলেন। ব্রহ্ম-অণ্ডটি দুই খণ্ড হইয়া এক খণ্ডে স্বর্গ ও অপর খণ্ডে পৃথিবীর সৃষ্টি হইল এবং মধ্যস্থানটিতে সৃষ্টি হইল আকাশ, অষ্টদিক ও সমুদ্রের। ইহাতে বুঝা যায় যে, সমুদ্র পৃথিবীতে অবস্থিত নহে, উহা শূন্যে অবস্থিত।
মনু (১; ১৫) –“আর সত্ত্ব, রজস্তমো গুণযুক্ত অন্য পদার্থসকল সৃষ্টি করিলেন এবং শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধের গ্রাহক শ্রোত্র, ত্বক, চক্ষু, জিহ্বা, নাসিকা — এই পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও বাক, পাদ, হস্ত, গুহ্য, উপস্থ –এই পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় সৃষ্টি করিলেন।”
এইখানে দেখা যায় যে, জীবসৃষ্টির পূর্বেই তাহার ইন্দ্রিয়সকল সৃষ্ট হইয়াছে।
মনু (১; ৩২) — “সৃষ্টিকর্তা জগদীশ্বর আপন শরীরকে দুই খণ্ড করিয়া অর্ধাংশ পুরুষ ও অর্ধাংশ নারী হইলেন। ঐ উভয়ের পরস্পর সংযোগে বিরাট নামক পুরুষ উৎপন্ন হইল।”
মনু (১; ৩৩) –“হে দ্বিজসত্তম! সেই বিরাট পুরুষ বহুকাল তপস্যা করিয়া যাহাকে সৃষ্টি করিলেন, আমি সেই মনু। আমাকে সৃষ্টিকর্তা বলিয়া অবগত হও।”
জগদীশ্বরের পুত্র বিরাট জন্মিলেন জগদীশ্বরীর গর্ভে এবং বিরাটের পুত্র মনু জন্মিলেন তাঁহার স্ত্রীর গর্ভে নহে, তপস্যার বলে। মনু সম্পর্কে হন জগদীশ্বরের পৌত্র (নাতি)। এই মনু হইতে উৎপত্তি হইয়াছে মনুষ্য বা মানব –এই নামটির।
মনু (১; ৩৪/৩৫) –“অনন্তর আমি (মনু) প্রজা সৃষ্টি করিবার অভিলাষে বহুকাল কঠোর তপস্যা করিয়া প্রথমে প্রজাসৃজনে সমর্থ দশজন প্রজাপতির সৃষ্টি করিলাম।”… যথা — “মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, প্রচেতা, বশিষ্ঠ, ভৃগু ও নারদ।”
এইখানেও মনু দশজন প্রজা (পুত্র) জন্মাইলেন তপস্যার বলে, কোনো নারীর গর্ভে নহে। বিশেষত কন্যা একটিও জন্মাইলেন না।
মনু (১; ৩৬–৪১) — “মরীচ্যাদি দশ প্রজাপতি আবার সাতজন মনু (মনুষ্য) সৃষ্টি করিলেন এবং সৃষ্টি করিলেন যক্ষ, রাক্ষস, পিশাচ, গন্ধর্ব, অপ্সরা, অসুর, মেঘ, বিদ্যুৎ, বজ, নক্ষত্র, ধূমকেতু, মানুষ, পশু, পাখি, সরীসৃপ-মৎস্যাদি জলজীব, উদ্ভিদ, কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি।”
মরীচ্যাদি দশ প্রজাপতি আবার সাতজন মনু সৃষ্টি করিলেন। কিন্তু এই সকল মনুরা প্রজাপতিদের ঔরসজাত, না হাতে গড়া, তাহার কোনো হদিস নাই। প্রতিমার মতো হাতে গড়া হইলে আবশ্যক ছিল উহাদের প্রাণ প্রতিষ্ঠার এবং ঔরসজাত হইলে আবশ্যক ছিল নারীর। কিন্তু কিছুরই উল্লেখ নাই।