অসম যমজ সন্তানেরা জরায়ুমধ্যে আলাদা আলাদা ডিম্ব হইতে আলাদা আলাদা ভুণে পরিণত হয় এবং উহাদের ফুল (Placenta) থাকে পৃথক পৃথক, অর্থাৎ যতটি সন্তান জন্মে ততটি। উহারা ভিন্ন ভিন্ন ভূণঝিল্লির ভিতরে বর্ধিত হয়। সন্তানেরা সকলে পুত্র বা সকলে কন্যা অথবা কতক পুত্র, কতক কন্যা হইতে পারে। সন্তানদের দৈহিক চেহারায় ও মানসিক বৃত্তিসমূহে অন্যান্য ভাই-ভগিনীর চেয়ে বেশি মিল থাকে না।
সম যমজ– যদি কখনও কোনো স্ত্রীলোকের একটি ডিম্ব জন্মিয়া শুক্রকীট যুক্ত হইবার পর কোনো কারণে দুই বা ততোধিক খণ্ডে খণ্ডিত হইয়া পড়ে, তবে উহার প্রত্যেক খণ্ড হইতে এক একটি সন্তান জন্মিতে পারে। উহারা একই সূণঝিল্লির মধ্যে আলাদা আলাদা ভূণে পরিণত হইয়া আলাদা আলাদা সন্তান জন্মে, কিন্তু ফুল থাকে একটি। সম যমজ সন্তানগণ হয়তো সকলেই পুত্র নচেৎ সকলেই কন্যা হইয়া থাকে। উহাদের দৈহিক গঠন ও মানসিক বৃত্তিসমূহে আশ্চর্য রকম মিল থাকে। একই ডিম্ব হইতে জন্মলাভ করে বলিয়া একই রকম যোগ্যতাসম্পন্ন হইয়া থাকে। শিল্প, সঙ্গীত, ধর্ম ইত্যাদির যে কোনো একটির প্রতি অনুরাগী হয় সকলে। উহাদের সকলের একই সময়ে স্বাস্থ্যভঙ্গ হয়, একই রুচিসম্পন্ন হয় এবং হাতের লেখাও একই রকম হয়। কেহ কেহ বলেন যে, উহারা দূরে দূরে থাকিয়া একই রকম স্বপ্ন দেখে। তবে পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে উহার কিছু ব্যতিক্রম হইতে পারে এবং কিছু কথার বাড়াবাড়িও হইতে পারে।
.
# বংশ প্রবাহে জীনের প্রভাব
জ্বীন-পরী –এই যুগল নামটি এদেশের আপামর জনসাধারণের কাছে অতি পরিচিত। কিন্তু উহাদের কাহারও সহিত আজ পর্যন্ত জনসাধারণের সাক্ষাতপরিচয় নাই। জ্বীন ও পরী সম্বন্ধে নানাবিধ কেচ্ছাকাহিনীর অন্ত নাই। জ্বীনগণ নাকি আগুনের তৈয়ারী অথচ অদৃশ্য, কিন্তু উহারা মানুষের মতোই এক ধরণের জীব। কোনো কোনো সময় কোনো কোনো জ্বীন নাকি মানুষের উপর বিশেষত মেয়েমানুষের উপর আশ্রয় করিয়া থাকে। উহাকে বলা হয় জ্বীনের দৃষ্টি। জ্বীনের আশ্রয় বা জ্বীনের দৃষ্টি যাহার উপর পতিত হয়, সে নাকি তাহার স্বকীয়তা হারাইয়া ফেলে এবং জ্বীনের মর্জিমাফিক কাজ করে। তথাকথিত জ্বীন ও তাহাদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে এক শ্রেণীর মানুষের পুরাপুরি আস্থা থাকিলেও কোনো বিজ্ঞানী আজ পর্যন্ত ঐরূপ কোনো জ্বীনের অস্তিত্বের সন্ধান পান নাই। তবে তাহারা আর এক ধরণের জীনের সন্ধান পাইয়াছেন। সেই জীনেরাও অদৃশ্য, অথচ মানুষের দেহ-মনের উপর আধিপত্য বিস্তার করিয়া থাকে।
সচরাচর দেখা যায় যে, জনক-জননীর সহিত ছেলে-মেয়েদের দৈহিক গঠন ও মানসিক বৃত্তিসমূহের কোনো না কোনো বিষয়ে কিছু না কিছু সাদৃশ্য থাকেই। জনক-জননীর দেহ হইতে জাতক উত্তরাধিকার সূত্রে যে সমস্ত গুণাগুণ প্রাপ্ত হইয়া থাকে, তাহার ধারক ও বাহক কি? এই প্রশ্নের উত্তরে কেহ কেহ বলিয়া থাকেন, “ওসব ইচ্ছাময়ের ইচ্ছা”। কিন্তু বিজ্ঞানীগণ বলেন অন্য কথা। তাহারা বলেন যে, উহার ধারক ও বাহক হইল জীন।
পূর্বে আলোচিত হইয়াছে যে, জীবের জাতীয়তা নির্ভর করে তাহার দেহের জীবকোষের অভ্যন্তরস্থ ক্রোমোসোম-এর সংখ্যার উপর। বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, সেই ক্রোমোসোমগুলিও নিরেট বা শূন্যগর্ভ নহে, উহাদেরও গর্ভে আছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক প্রকার বিন্দু বিন্দু পদার্থ, যাহাদের অণুবীক্ষণেও দেখা যায় না। তাহারা এই জাতীয় অণুকণার নাম দিয়াছেন জীন (Gene)। তাহারা আরও বলেন যে, জনক-জননী তাহাদের ব্যক্তিত্বের যাহা কিছু জাতককে দান করে, এই জীনগণই তাহা বহন করিয়া আনিয়া থাকে। যেমন –চেহারা, চরিত্র, রুচি, অভিলাষ, কণ্ঠস্বর, বাচনভঙ্গি, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি। এতদ্ভিন্ন কতিপয় শারীরিক ও মানসিক ব্যাধিও মাতা-পিতার নিকট হইতে সন্তান-সন্ততিরা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হইয়া থাকে। যথা –যক্ষ্মা, উপদংশ, উন্মাদ ইত্যাদি। ইহাদেরও ধারক ও বাহক হইল জীন। তবে পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে এবং অন্যান্য কতিপয় কারণে সব ক্ষেত্রে উহা প্রকট রূপ নেয় না।
.
# কৃত্রিম প্রজনন
মানুষের দৈহিক ও মানসিক শক্তির সমষ্টিকেই বলা হয় ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিত্বের অনেক কিছুই লাভ করে মানুষ প্রকৃতি হইতে, জন্মের পর। যেমন –দৈহিক শক্তি অর্জনের জন্য নানাবিধ পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ এবং মানসিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য বিবিধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা সমাজের নিকট হইতে শিক্ষা গ্রহণ ইত্যাদি। এইভাবে যে সমস্ত শক্তি অর্জন করা হয়, তদ্বারা দেহযন্ত্র ও মনোবৃত্তিসমূহের পুষ্টি সাধিত হয় বটে, কিন্তু সৃষ্টি হয় না কিছুরই। ব্যক্তিত্বের মূল বিষয়বস্তু যাহা, তাহা অর্জিত নহে, জন্মগত বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত।
উত্তরাধিকার প্রাপ্তি কখনও অনিয়মিতভাবে হয় না। সভ্য মানব সমাজে বিশেষত মুসলিম জগতে উত্তরাধিকার বিষয়ক একটি পাকাপাকি বিধান রহিয়াছে, যাহাকে বলা হয় ফরায়েজ বিধান। দ্রুপ জীবজগতেও একটি উত্তরাধিকার বিধান রহিয়াছে। তবে পূর্বাবধি উহা ছিল মানুষের অজ্ঞাত। কিন্তু বর্তমানে জানা গিয়াছে উহার ধারা-উপধারা সবই।
পিতা তাহার সুযোগ্য পুত্রের হাতে সংসারের অনেক কাজ করিবার ক্ষমতা অর্পণ করিয়া থাকেন। অনুরূপ ভগবান তাহার নিজের করণীয় অনেক কাজ করিবার ক্ষমতাহবত মানে ছাড়িয়া দিয়াছেন বিজ্ঞানীদের হাতে। ইহার মধ্যে একটি কাজ হইল কৃত্রিম প্রজনন। এই কাজের জন্য ভগবান পথনির্দেশ দিলেন তাহার পুত্র (?) মেণ্ডেলকে ১৯ শতকের মধ্যভাগে।