.
# মানুষের জন্ম প্রকরণ
ভ্রূণ সৃষ্টি
পুরুষের প্রধান জননেন্দ্রিয়ের নাম শুক্রাশয় (Testes)। ইহার ভিতর পাশাপাশি বীচির মতো দুইটি গ্ল্যাণ্ড আছে। গ্ল্যাণ্ডের ভিতরের স্তরের সেলগুলির কাজ –ক্রমাগত ভাগ হইয়া নূতন সেল তৈয়ার করা। সেগুলি দেখিতে ব্যাঙাচির মতো, কিন্তু এত ছোট যে, অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া দেখা যায় না। এই সেলগুলির নাম জননকোষ বা পুং জার্মসেল। ইহারা শুক্রাশয়ের ভিতরে যথেচ্ছ সঁতরাইয়া বেড়ায়। শুক্রাশয়ের সাথে দুইটি সরু নল দিয়া মূত্রনালীর যোগ আছে। দরকারের সময়। জার্মসেলগুলি ঐ নল বাহিয়া মূত্রনালীর ভিতর দিয়া বাহিরে আসিতে পারে।
নারীর শরীরের ব্যবস্থা অন্য রকম। তাহার প্রধান জননেন্দ্রিয় ওভারিদ্বয় (Ovaries) তলপেটের ভিতরে ছোট দুইটি গ্ল্যাণ্ড। উহাদের ভিতরে নির্দিষ্ট সময়ে (পুরুষের মতো সব সময় নহে) একটি করিয়া (পুরুষের মতো অসংখ্য নহে) ডিম্বকোষ বা স্ত্রী জার্মসেল প্রস্তুত হয়। ডিম্বকোষ পুরুষদের জননকোষের তুলনায় অনেক বড়। ওভারির ভিতরে ডিম্বকোষ প্রস্তুত হইয়া পূর্ণতা লাভ করিলেই উহা নলের ভিতর দিয়া জরায়ুতে নামিয়া আসে। জরায়ু শক্ত রবারের মতো একটি থলি। সাধারণ অবস্থায় উহা মাত্র ৩ ইঞ্চি লম্বা। কিন্তু প্রয়োজনমতো যথেচ্ছ বড় হইতে পারে।
স্ত্রী-পুরুষের মিলনের সময়ে পুরুষের অসংখ্য জামসেল স্ত্রীঅগ দিয়া প্রবেশ করিয়া জরায়ুর ভিতরে ঢুকে। সেখানে স্ত্রীর ডিম্বকোষ তৈয়ারী থাকে উহাদের অভ্যর্থনার জন্য। জার্মসেল বা শুক্রকীটগুলি জরায়ুতে প্রবেশ করিয়াই লেজ নাড়িয়া (ব্যাঙাচির মতো ইহাদের লেজ থাকে) সাঁতার কাটিয়া ডিম্বকোষের দিকে ছুটিয়া আসে। উহাদের মধ্যে মাত্র একটিই ডিম্বকোষের ভিতরে ঢুকিতে পারে, কেননা একটি ঢুকা মাত্রই ডিম্বকোষের বাহিরের পর্দায় এমন পরিবর্তন ঘটে যে, অন্য কোনো শুক্রকীট আর ঢুকিতে পারে না। ডিম্বকোষের মধ্যে ঢুকিবার সময়ে শুক্রকীটের লেজটি খসিয়া বাহিরে থাকিয়া যায়।
মানুষের বেলায় সচরাচর প্রতি মাসে নির্দিষ্ট দিনে একটি করিয়া ডিম্বকোষ স্ত্রীলোকের ওভারিতে প্রস্তুত হইয়া জরায়ুমধ্যে শুক্রকীটের আগমনের জন্য অপেক্ষা করিতে থাকে। কোনো জন্তুর তিন মাস, কোনো জন্তুর ছয় মাস, কাহারও বা বৎসরান্তে একবার ডিম্বকোষ জন্মে। যদি সেই সময় পুরুষ জামসেলের সঙ্গে উহার মিলন না হয়, তবে দুই-চারি দিনের মধ্যেই। ডিম্বকোষটি শুকাইয়া মরিয়া যায়। আবার যথাসময়ে (ঋতুতে) আর একটি প্রস্তুত হয়।
পুরুষ ও স্ত্রী সেলের মিলন হইলে মিলনের পরমুহূর্ত হইতে ডিম্বকোষের মধ্যে আশ্চর্য পরিবর্তন ঘটিতে থাকে। স্ত্রী জার্মসেলের মধ্যে ঢুকিবার পর পুরুষ জার্মসেল অর্থাৎ শুক্রকীটের কোষকেন্দ্র আরও বড় হইতে থাকে এবং খানিক বড় হইয়া স্ত্রী জার্মসেলের কোষকেন্দ্রের সঙ্গে একেবারে মিশিয়া যায়। নানা বৈচিত্রময় পরিবর্তনের পর আরম্ভ হয় বিভাজন। একটি হইতে দুইটি, দুইটি হইতে চারিটি এবং তাহা হইতে আটটি –এইভাবে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাইয়া তিন সপ্তাহের মধ্যে ডিম্বকোষ সংখ্যায় বাড়িয়া গিয়া আয়তনে এত বড় হয় যে, তখন ভুণ বলিয়া তাহাকে চেনা যায়। মানুষের বেলায় শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গই পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে স্পষ্ট ফুটিয়া উঠে। কিন্তু তখনও উহা ১ ইঞ্চির বেশি বড় হয় না। দুই মাস পরে পুরা এক ইঞ্চি হয় এবং তখন হইতে উহাকে মানুষের ভূণ বলিয়া চেনা যায়। পুরাপুরি শিশুর মতো হইতে সময় লাগে আরও সাত মাস। ন্যূনাধিক নয় মাস (চলিত কথায় দশ মাস) পর জরায়ু বা মাতৃজঠর ত্যাগ করিয়া ভূমিষ্ঠ হয় মানবশিশু।
নারী ও পুরুষের মিলনের অর্থই হইল শুক্রকীট ও ডিম্বকোষের মিলন সাধন। নারী ও পুরুষের রতিক্রিয়া ব্যতীতও যৌনমিলন সম্ভব হইতে পারে। ইহাতে কোনো পুরুষের বীর্য ধারণপূর্বক তাহা যথাসময়ে কোনো কৌশলে নারীর জরায়ুমধ্যে প্রবেশ করাইয়া যৌনমিলন অর্থাৎ শুক্রকীট ও ডিম্বকোষের মিলন ঘটাইতে পারা যায় এবং তাহাতে সন্তানোৎপত্তি হইতে পারে। কিন্তু কোনো প্রকারের যৌনমিলন ব্যতীত সন্তানোৎপত্তি হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব।
ধর্মজগতে এমন কতগুলি আখ্যায়িকা প্রাপ্ত হওয়া যায়, যাহা প্রোক্ত নিয়মের ব্যতিক্রম। শুনা যায় যে, কামোত্তেজনাবশত কোনো মহাপুরুষের বীর্যস্থলন হইলে, উহা কোনো পাত্রে রাখা হইল এবং ঐ পাত্ৰমধ্যে সন্তান জন্সিল, অথবা কোনো ইতর জীবে উহা ভক্ষণ করিল, আর ঐ ইতর জীবের উদরে (জরায়ুতে নহে) সন্তান জন্মিল ইত্যাদি। আবার কোনো রমণী কোনো পুরুষকে স্বপ্নে দেখিয়া বা কাহাকেও চুমা খাইয়া কিংবা কোনো স্বর্গীয় দূতের বাণী শ্রবণ করিয়াই গর্ভবতী হইল ও সন্তান প্রসব করিল ইত্যাদি। ইহাতে কোনো নারী ও পুরুষ অর্থাৎ শুক্রকীট ও ডিম্বকোষের মিলনের আবশ্যক হইল না। কিন্তু এই জাতীয় অলৌকিক কাহিনীগুলি বিশ্লেষণ করিলে কোনো কোনোটিকে মনে হয় যে, উহা অলীক কল্পনা এবং কোনো কোনোটিতে পাওয়া যায় লৌকিকতার আভাস।
রামায়ণোক্ত সীতাকে বলা হয় অযযানিসম্ভবা। কেননা, তাহার নাকি মাতা ও পিতা কিছুই নাই এবং বাইবেলোক্ত যীশু খ্রীস্টকে বলা হয় অশিশ্নসম্ভব। কেননা, তাহার মাতা আছেন, পিতা নাই। কিন্তু উভয়ত আবার কিংবদন্তীও আছে। কোনো কোনো মতে –সীতা নাকি লঙ্কেশ্বর রাবণের কন্যা। ঐ কন্যাটি জমিলে কোনো গণক রাবণকে নাকি বলিয়াছিলেন যে, ঐ কন্যাটির উপলক্ষে তাহার মৃত্যু হইবে। তজ্জন্য রাবণরাজ কন্যাটিকে কোনো পাত্রে রাখিয়া সমুদ্রজলে ভাসাইয়া দেন এবং কোনো রকমে কন্যাসহ ঐ পাত্রটি মিথিলার রাজা জনকের হস্তগত হইলে তিনি ঐ কন্যাটিকে প্রতিপালন করেন ও রামের নিকট বিবাহ দেন ইত্যাদি।