দেহকোষ ও জননকোষের বিভাজন প্রণালী একই, অর্থাৎ একটি কোষ বিভক্ত হইয়া দুইটি, দুইটি হইতে চারিটি এবং তাহা হইতে আটটি –এইরূপ সংখ্যাবৃদ্ধি হইয়া থাকে। ব্যতিক্রম হইল এই যে, দেহকোষ বিভক্ত হওয়ার ফলে ঐ জীবটির দেহের বৃদ্ধি বা পুষ্টি হয় এবং জননকোষ বিভক্ত হইয়া জন্ম হয় ঐ জীবটির সদৃশ আর একটি স্বতন্ত্র জীবের। কিন্তু জননকোষদ্বয় একা একা বিভক্ত হইতে পারে না। ইহাতে আবশ্যক হয় পুং জননকোষ ও ডিম্বকোষের লন। এই মিলনকে বলা হয় যৌনক্রিয়া।
মানুষ, পশু, পাখি ইত্যাদি উন্নত পর্যায়ের জীবসমূহের স্ত্রী-পুরুষ ভেদ আছে এবং উহারা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হইয়া যৌনক্রিয়া সম্পাদন করে। কিন্তু জোক, কেঁচো ও শামুকাদি নিম্নস্তরের জীবের ও অধিকাংশ উদ্ভিদের দেহে দুই জাতীয় কোষ মজুত থাকে এবং জল, বায়ু, মাছি ইত্যাদির দ্বারা ঐ দুই জাতীয় কোষের মিলন সাধিত হয়। মিলনমুহূর্তের পর হইতেই আরম্ভ হয় মিলিত কোষটির বিভাজন এবং বিভক্ত হইতে হইতে জন্ম হয় একটি পূর্ণাঙ্গ (সদৃশ) জীব বা উদ্ভিদ-এর।
যতদিন পর্যন্ত এককোষী জীবেরা নিজেদের কেবল দুই ভাগ করিয়া বংশবৃদ্ধি করিত, ততদিন পর্যন্ত জীবজগতে বিশেষ কোনো বৈচিত্র দেখা দেয় নাই। যখন হইতে স্ত্রী-পুরুষ দুইজনের মিলনে বংশবৃদ্ধি হইতে আরম্ভ হইল, তখন হইতে প্রাণীজগতে শুরু হইল নানা পরিবর্তন ও দ্রুত উন্নতি। একটি কোষকে সমান দুই ভাগ করিলে, খণ্ড দুইটি জনয়িতার হুবহু নকল হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু যে স্থলে জনক ও জননী- দুইটি স্বতন্ত্র ব্যক্তি হইতে সন্তানের জন্ম, সেই স্থলে জন্মদাতাদের সঙ্গে সন্তানের ঐকান্তিক মিল তো থাকিতেই পারে না, বরং সন্তানদের পরস্পরের মধ্যেও পার্থক্য থাকে যথেষ্ট। জীবজগতের এতোধিক বৈচিত্রের মূল কারণও হইল যৌন প্রণালীতে বংশবৃদ্ধি।
অতি সাধারণভাবে জীবজগতের বৈচিত্র প্রকাশের কারণ বলা হইল। এখন প্রশ্ন থাকিল এই যে, জীবজন্তুর শরীরে এত রকমের ইন্দ্রিয়, অবয়ব ও যন্ত্রাদির সৃষ্টি হইল কি রকম? এই বিষয়ে বিজ্ঞানীগণ যাহা বলেন, তাহার সারমর্ম এই যে, পৃথিবীর আদিম অবস্থায় কেবল জলজন্তুই ছিল। অ্যামিবা পর্যায় অতিক্রম করিয়া যখন বহুকোষী জলজীব দেখা দিল, তখন তাহারা স্থিরভাবে জলে ভাসিয়া না থাকিয়া কোনো একদিকে জল ঠেলিয়া যাইতে চেষ্টা করিতে লাগিল। সেই অবস্থায় তাহাদের সামনের দিকের সেলগুলি প্রথম খাবারের সন্ধান পাইতে লাগিল, এবং বিরুদ্ধ অবস্থার সঙ্গে সর্বপ্রথম তাহাদের সংঘর্ষ হইতে লাগিল। তাই সামনের দিকের সেলগুলি খাবার সংগ্রহ, শত্রুকে এড়ানো বা দমন করা, দিক নির্ণয় করা প্রভৃতি কাজের ভার লইয়া নিজেদেরকে বিশেষভাবে ঐ কাজের উপযোগী করিয়া তুলিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। এই চেষ্টার ফলে জীবদেহে আস্তে আস্তে গড়িয়া উঠিল মস্তিষ্ক। প্রথমে আহার্য দ্রব্য ভিতরে নিবার জন্য মুখগহ্বর ও গলনালী, পরে চোখ, কান প্রভৃতি বাহেন্দ্রিয়গুলি এবং সঙ্গে সঙ্গে মগজ দেখা দিল। পারিপার্শ্বিক অবস্থার ভিন্নতা বা পরিবর্তন অনুসারে জীবদেহের এই সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বৈশিষ্টও বৃদ্ধি পাইতে লাগিল, আর প্রয়োজনবোধে প্রকাশ পাইল লেজ, ডানা, হাত, পা প্রভৃতি বহিরঙ্গগুলি।
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, প্রাণীজগতের বিবর্তনের শুরুতে যে রকম করিয়াই ভিন্ন ভিন্ন জাতির উৎপত্তি হইয়া থাকুক না কেন, বর্তমানে উহার জাতীয়তা রক্ষার কারক সেলের অভ্যন্তরস্থ ক্রোমোসোম। কোনো কোনো জাতের সেল সহজ দৃষ্টিতেই দেখা যায়, আবার কোনো কোনো সেল এত ছোট যে, উহার ২৫০০টি সেল এক সারিতে সাজাইলে এক ইঞ্চির বেশি লম্বা হয় না। এত ছোট সেলের ভিতরটি কিন্তু ফুটবলের মতো শূন্যগর্ভ নহে, সেখানে আছে বহু পদার্থ, যাহা ভাবী জীবের জাতি ও প্রত্যঙ্গাদি সৃষ্টির কারক। সেলের মধ্যে ঐ ধরণের একটি পদার্থ ক্রোমোসোম। এই ক্রোমোসোমই জীবের জাতিভেদের জন্য দায়ী।
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, প্রত্যেক ধাতব পদার্থের পরমাণুতে নির্দিষ্ট সংখ্যক ইলেকট্রন ও প্রোটন থাকে। যেমন –সোনায় ৭৯, রূপায় ৪৭, লোহায় ২৬ ইত্যাদি। একটি পরমাণুতে ৮০টি ইলেকট্রন বা প্রোটন আছে, এইরূপ সোনা জগতে মিলিবে না। কেননা, ঐরূপ সংখ্যা থাকিলে তাহা হইবে পারদ। জীবজগতেও ঐ রকম প্রত্যেক জাতীয় জীবের দেহকোষ বা জননকোষের মধ্যে এক। নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্রোমোসোম থাকে, কোথায়ও উহার ব্যতিক্রম হয় না। ধাতব পদার্থের মৌলিকত্ব নির্ভর করে যেমন তাহার পরমাণুর ইলেকট্রন-প্রোটনের সংখ্যার উপর, জীবের জাতীয়তা নির্ভর করে তেমন তাহার দেহের সেলের ক্রোমোসোমের সংখ্যার উপর। কয়েক জাতীয় সেলের ক্রোমোসোমের সংখ্যা দেওয়া গেল।
উদ্ভিদ জীব
বাঁধাকপি – ১৮ গরু – ১৬
ভুট্টা – ২০ কুকুর – ২২
ধান – ২৪ ব্যাঙ – ২৬ মানুষ – ৪৬
গম – ৪২ ঘোড়া – ৩৮ বাঁদর – ৫৪
মানুষের শরীরের যে কোনো অংশের সেল অণুবীক্ষণের সাহায্যে দেখিলে দেখা যাইবে যে, উহার প্রত্যেকটি সেলে ৪৬টি করিয়া (আগে বলা হইত ৪৮টি) ক্রোমোসোম আছে। এক জাতীয় জীবের মধ্যে ক্রোমোসোমের সংখ্যার কখনও ব্যতিক্রম হয় না। জাতি ভেদে সংখ্যার তারতম্য হয় বটে।[২৭]