তাহা হইলে মানুষের বৈশিষ্ট কোথায়?
.
# মানুষের বৈশিষ্ট
মানুষের সহিত অন্যান্য জীবদের তথা পশুদের শত শত রকম সামঞ্জস্য বিদ্যমান। কাজেই যাবতীয় জীব বিশেষত পশুরা মানুষের আত্মীয়, এ কথাটি অস্বীকার করিবার উপায় নাই। তথাপি মানুষ মানুষই, পশু নহে। এখন দেখা যাক যে, অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের তফাত কি।
জীবজগতে মানুষের প্রধান বৈশিষ্ট তিনটি। যথা –হাত, মগজ ও ভাষা।
বিবর্তনের নিয়ম-কানুনে বিজ্ঞানীদের মধ্যে কোনো কোনো বিষয়ে দ্বিমত থাকিলেও একটি বিষয়ে প্রায় সকল বিজ্ঞানীই একমত যে, মানুষের পূর্বপুরুষেরা এককালে পুরাপুরি বৃক্ষচারী জীব ছিল। কালক্রমে যখন তাহারা গাছের বাসা ছাড়িয়া মাটিতে নামিয়া আসিল, তখন অন্যান্য অনেক জানোয়ারের তুলনায় নানা দিক দিয়াই তাহারা ছিল অসহায়। জীবন সংগ্রামের জন্য ছিল তাহাদের প্রধানত দুইটি সম্বল। প্রথমত অন্যদের তুলনায় ভালো মস্তিষ্ক, দ্বিতীয়ত চলাফেরার কাজ হইতে মুক্তি পাওয়া’ দুইখানি হাত। ইহারই সাহায্যে মানুষ বাঁচিবার চেষ্টা করিয়াছে। ফলে উন্নত হইয়াছে মানুষের মস্তিষ্ক এবং হাত দুইই। মস্তিষ্কের উন্নতি হাতকে উন্নত করিয়াছে, আবার হাতের উন্নতি মস্তিষ্ককে উন্নত করিয়াছে। অধিকন্তু মস্তিষ্ক এবং হাত, এই দুইয়ের উপর নির্ভর করিয়া মানুষ কথা বলিতে শিখিয়াছে, ভাষা পাইয়াছে। এই ভাষা কাহারও একার সম্পত্তি নহে, পুরা সমাজের সম্পত্তি। তাই ভাষাভাষী হিসাবে মানুষ একান্তই সামাজিক জীব। উন্নত মস্তিষ্ক, কর্মক্ষম হাত এবং সুসমঞ্জস ভাষা সহায়ক হইল এক রকম জীবের — তাহারই নাম মানুষ। কিন্তু হাত, মগজ ও ভাষা জীবজগতের সর্বত্র দুর্লভ নহে। অনুন্নত জীবজগতের সর্বত্র দুর্লভ– মানুষের হাসি।
.
# বিবর্তনের কয়েকটি ধাপ
ক্রমবিবর্তনের বিষয়ে এযাবত যে সমস্ত আলোচনা করা হইল এবং তাহাতে যে সমস্ত জীবের নামোল্লেখ করা হইল, তাহা বিবর্তনের প্রধান প্রধান ধাপ মাত্র। এক জাতীয় জীবের আর এক জাতীয় জীবে রূপান্তরিত হইতে সময় লাগে লক্ষ লক্ষ বা কোটি কোটি বৎসর এবং ইহারই মধ্যে ঐ জীবটি রূপান্তরিত হয় আরও শত শত জীবে। কিন্তু এই মধ্যবর্তী জীবগুলি প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াইতে পারার দরুন অথবা অন্য কোনো কারণে অধিকাংশই পৃথিবীর বুকে টিকিয়া থাকিতে পারে না, কৃচিৎ অনুন্নত অবস্থায় বাঁচিয়া থাকে। যেমন –আফ্রিকার কোয়েলাকান্থ ও ফুসফুসওয়ালা মাছ; ইহারা মৎস্য ও সরীসৃপের মাঝামাঝি জীব। যেমন– গরিলা; ইহারা পশু ও মানুষের মাঝামাঝি জীব। যেমন –আর্কিওপটেরিক; ইহারা পাখি ও সরীসৃপের মাঝামাঝি জীব ইত্যাদি। যাহা হউক, বিবর্তনের আলোচ্য প্রধান প্রধান ধাপগুলি সম্বন্ধে আর একবার সংক্ষেপে আলোচনা করিতেছি।
অ্যামিবা ইহারা এককোষী জীব। ইহার বিবর্তনে অর্থাৎ কোষ সমবায়ে গঠিত হইয়াছে বহুকোষী জীব।
বহুকোষী জীব ইহারা দুই দলে বিভক্ত হইয়া এক দল হইতে অচল উদ্ভিদ এবং অপর দল হইতে জন্মিয়াছে সচল জীব।
সচল জীব ইহাদের এক শ্রেণীর জীবের নাম ট্রাইলোবাইট।
ট্রাইলোবাইট ইহারা পোকা জাতীয় জলজীব। কালক্রমে ইহাদের এক শ্রেণীর দেহে মেরুদণ্ড জন্মে, তাহাদের বলা হয় মাছ।
মাছ ইহাদের বংশ হইতে জন্মে জলচর, উভচর, বিহঙ্গম ও স্থলচর সরীসৃপ।
সরীসৃপ ইহাদের এক শাখা হইতে জন্মে উষ্ণ রক্ত বিশিষ্ট স্তন্যপায়ী জীব।
স্তন্যপায়ী জীব ইহাদের এক শাখা হয় বৃক্ষচারী জীব, তাহাদের বলা হয় প্রাইমেট।
প্রাইমেট ইহাদের মধ্যে জন্মে দ্বিপদ জীব, যাহাদের বলা হয় প্যারাপিথেকাস।
প্যারাপিথেকাস ইহাদের মধ্য হইতে একদল জন্মে পুরাপুরি সমতলভূমিবাসী দ্বিপদ জীব। ইহাদের বলা হয় এ্যানথ্রোপয়েড এপ বা বনমানুষ।
বনমানুষ ইহাদের ক্রমোন্নতির ফলে জন্মিয়াছে অসভ্য ও আধুনিক সভ্য মানুষ।
————
[২৬. পৃথিবীর ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃ. ২৬১।]
১১. বংশগতি
বংশগতি
জীবের বংশপ্রবাহ
জীববিজ্ঞানীগণ বলেন যে, পৃথিবীর যাবতীয় জীবদেহই কোষ বা সেল সমবায়ে গঠিত। অ্যামিবার মতো এককোষবিশিষ্ট জীবেরা বংশবৃদ্ধি করে নিজেকে দুই ভাগ করিয়া। এই ভাগ হওয়াটিকে বলা হয় বিভাজন। বিভাজনের প্রণালী বা কোষাভ্যন্তরের কাণ্ডকারখানা কিছু জটিল। তাই উহার জটিলতাকে বাদ দিয়া আমাদের শুধু এইটুকু জানিয়া রাখা ভালো যে, কোষগুলি পুষ্টিকর আহার পাইলে যথাসময়ে ফাটিয়া যায় ও একটি কোষ দুইটি পূর্ণাঙ্গ কোষে পরিণত হয়। এইরূপে চলিতে থাকে জীবাণুদের বংশবৃদ্ধি।
জীবাণুদের বংশবৃদ্ধির কাজে সময় বেশি লাগে না। কোনো কোনো জীবাণু আশ্চর্য রকম বংশবৃদ্ধি করিতে পারে। প্যারামেসিয়ান নামক প্রোটোজোয়া জাতীয় জীবাণুর সেল এক ইঞ্চির একশত ভাগের এক ভাগের চেয়ে বেশি বড় নহে। তাহার একটি মাত্র জীবাণু লইয়া এক বাটি জলের মধ্যে যদি ছাড়িয়া দেওয়া যায়, তবে সাত দিন পরে গণনা করিলে দেখা যাইবে যে, সেই একটি হইতে জীবাণু জন্মিয়াছে প্রায় দশ লক্ষ। অধিকাংশ রোগের জীবাণুরা এই রকম বা ইহার অপেক্ষাও বেশি বংশবৃদ্ধি করিয়া থাকে।
এককোষী জীবেরা যেমন নিজেকে দুই ভাগ করিয়া বংশবৃদ্ধি করিতে পারে, বহুকোষী জীবেরা তাহা পারে না। বহুকোষী জীব যথা –কীট, পতঙ্গ ইত্যাদির দেহের কোষগুলি দুই জাতীয়। যথা– দেহকোষ এবং জননকোষ। জননকোষগুলি আবার দুই জাতীয়। যথা –পুং জননকোষ এবং স্ত্রী জননকোষ বা ডিম্বকোষ।