ক্রো-মাঞঁ মানুষ –১৮৬৮ সালে ফ্রান্সের দোর্দোন অঞ্চলে পাঁচটি পূর্ণাবয়ব কঙ্কাল পাওয়া যায়। উহাকে বলা হয় ক্রোমাঞ (Cro-Magnon) মানুষ। লম্বায় ৫ ফিট ১১ ইঞ্চি হইতে ৬ ফিট ১ ইঞ্চির মধ্যে। ইহাদের লম্বাটে মাথা, থ্যাবড়া মুখ, পেশীবহুল প্রত্যঙ্গ, উঁচু চোয়াল। চেহারার দিক দিয়া পুরাপুরি আধুনিক মানুষ। কালগুলির বয়স মাত্র ৩০ হাজার বৎসর।[২৬]
জীববিজ্ঞানীগণ বলেন যে, পৃথিবীতে জীবের আবির্ভাব হইয়াছে প্রায় দেড়শত কোটি বৎসর আগে। কিন্তু মানুষ বর্তমান মানুষের রূপ পাইয়াছে মাত্র ত্রিশ হাজার বৎসর আগে।
.
# মানুষ ও পশুতে সাদৃশ্য
ধর্মাচার্যগণ বলিয়া থাকেন যে, যাবতীয় জীবের মধ্যে মানুষ ঈশ্বরের শখের সৃষ্ট জীব এবং উহা পবিত্র মাটির তৈয়ারী। আকৃতি-প্রকৃতি ও জ্ঞানে-গুণে মানুষের সমতুল্য কোনো জীবই নাই। অর্থাৎ জীবজগতে মানুষ অতুলনীয় জীব। কিন্তু বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, জীবজগতে মানুষের তেমন কোনো বৈশিষ্ট নাই। আপাতদৃষ্টিতে যে সমস্ত বৈশিষ্ট দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা হইল ক্রমবিবর্তনের ফল। মৌলিক বৈশিষ্ট বিশেষ কিছুই নাই এবং যাবতীয় জীবদেহের মৌলিক উপাদান একই।
মানুষের রক্তের প্রধান উপাদান শ্বেত কণিকা, লোহিত কণিকা, জল ও লবণ জাতীয় পদার্থ এবং দেহ বিশ্লেষণ করিলে পাওয়া যায় লৌহ, কার্বন, ফসফরাস ও গন্ধকাদি কতিপয় মৌলিক পদার্থ। দেখা যায় যে, অন্যান্য প্রাণীর দেহের উপাদানও উহাই।
জীবগণ আহার করে দেহের স্বাভাবিক ক্ষয় পুরণের জন্য। ইহাতে জানা যায় যে, শরীরের যে বস্তুটি ক্ষয় হইতেছে, তাহা পূরণ করিবার জন্যই আহাবের প্রয়োজন। জীবজগতে যখন খাদ্য-খাদক সম্পর্ক বর্তমান আছে, তখন উহাদের দেহগঠনের উপাদানও হইবে বহুল পরিমাণে এক। যেমন– বাঘ মানুষ ভক্ষণ করে, মানুষ মাছ আহার করে, আবার মাছেরা পোকা-মাকড় খাইয়া বঁচিয়া থাকে ইত্যাদি। ইহাতে বুঝা যায় যে, একের শরীরের ক্ষয়মান পদার্থ অপরের শরীরে বিদ্যমান আছে। মাতৃহীন শিশু যখন গোদুগ্ধ পানে জীবন ধাবণ করিতে পারে, তখন গাভী ও প্রসূতির দেহের উপাদান বহুলাংশে এক।
প্লেগ, জলাতঙ্ক প্রভৃতি রোগসমূহ ইতর প্রাণী হইতে মানবদেহে এবং মানবদেহ হইতে ইতর প্রাণীতে সংক্রমিত হইতে পারে। ইহাতে উহাদের টিস্যু (tissue) ও রক্তের সাদৃশ্য প্রমাণিত হয়।
চা, কফি ও মাদক জাতীয় দ্রব্যাদি গ্রহণে ও কতক বিষাক্ত দ্রব্য প্রয়োগে মানুষ ও পশুর একই লক্ষণ প্রকাশ পায়, ইহাতে উভয়ের পেশী (muscle) ও স্নায়ুর (nerve) সাদৃশ্য প্রমাণিত হয়।
গো-মহিষাদি পশুরা লোমশ প্রাণী, মানুষও তাহাই এবং পশুদের দেহে যেরূপ পরজীবী বাস করে, মানুষের শরীরেও তদ্রূপ উকুনাদি বাস করে। প্রজননকার্যে মানুষ ও অন্যান্য স্তন্যপায়ী জীবদের বিশেষ কোনো পার্থক্য নাই। পূর্বরাগ, যৌনমিলন, সূণোৎপাদন, সন্তান প্রসব ও প্রতিপালন সকলই প্রায় একরূপ।
স্তন্যপায়ী সকল জীবকেই রজঃশীলা হইতে দেখা যায়। তবে বিভিন্ন জীবের যৌবনে পৌঁছিবার বয়স, রজঃ-এর লক্ষণ ও স্থিতিকাল এবং গর্ভকাল এক নহে। তথাপি একজন মানবীর রজঃ বা ঋতুর অন্তর এক মাস (সাধারণত ২৮ দিন) এবং একটি বানরীরও এক মাস, আর একজন মানবীর গর্ভধারণকাল দশ মাস (সাধারণত নয় মাস) এবং একটি গাভীরও গর্ভধারণকাল ঐরূপ।
মানুষের ন্যায় পশু-পাখিরও সন্তানবাৎসল্য এবং সামাজিকতা আছে। মানুষ যেরূপ আহ, উহ, ইশ ইত্যাদি অনেক প্রকার শব্দ দ্বারা হর্ষ, বিষাদ, ভয়, ক্রোধ ইত্যাদি মানসিক ভাব ব্যক্ত করে, তদ্রূপ অনেক ইতর প্রাণীও কতক সাঙ্কেতিক শব্দ দ্বারা মনোভাব ব্যক্ত করিয়া থাকে। গৃহপালিত কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দের পাঁচটি রকমভেদ আছে। ইহাতে শত্রুর আগমনের বার্তা, হর্ষের শব্দ, বেদনার শব্দ ইত্যাদি লক্ষিত হয়। গৃহপালিত মোরগ প্রায় বারোটি শব্দ ব্যবহার করে। গাভীর হাম্বা রবে তিন-চারি প্রকার মনোভাব প্রকাশিত হয়। ইতর প্রাণী কথা যে একেবারেই বলিতে পারে না, এমন নহে। ময়না, টিয়া, কাকাতুয়া ইত্যাদি পাখিরা মানুষের মতোই কথা বলিতে শেখে।
গরু, ঘোড়া, হাতি, বাঘ, শিয়াল, বিড়াল ইত্যাদি পশুরা পঞ্চ-ইন্দ্রিয়-বিশিষ্ট জীব, মানুষও তাহাই। ঐসকল পশুর এবং মানুষের রক্ত, মাংস, মেদ, মজ্জা, অস্থি ইত্যাদিতে কোনো পার্থক্য তো নাই-ই, উহাদের অভ্যন্তরীণ দেহযন্ত্র যথা –হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, প্লীহা, যকৃত, মূত্রযন্ত্র, পাকস্থলী ইত্যাদির গঠন, ক্রিয়া, সংযোজন ও অবস্থিতি তুলনা করিলেও বিশেষ কোনো পার্থক্য লক্ষিত হয় না। বিশেষত শিম্পাঞ্জি, গরিলা ও বানরের সহিত মানুষের আকৃতি ও প্রকৃতির সাদৃশ্য যথেষ্ট।
জীববিজ্ঞানীগণ স্তন্যপায়ী শ্রেণীর জীবসমূহকে কতগুলি দল বা বর্গ-এ বিভক্ত করিয়াছেন। উহার বিশেষ একটি বর্গের সমস্ত প্রাণীকে একত্রে বলা হয় প্রাইমেট (Primate)। যাহারা হাত দিয়া জড়াইয়া ধরিয়া গাছে উঠিতে পারে, যাহাদের হাতে পাঁচটি করিয়া আঙ্গুল আছে, যাহাদের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ অন্যান্য আঙ্গুলগুলির উপর ন্যস্ত করা যাইতে পারে, যাহাদের আঙ্গুলে নখ থাকে, যাহাদের অক্ষিগোলক চতুর্দিকে অস্থি দ্বারা পরিবৃত, যাহাদের স্তনগ্ল্যাণ্ড বক্ষদেশে নিবদ্ধ এবং যাহাদের পাকস্থলী সাধারণভাবে গঠিত –তাহারাই প্রাইমেট বর্গের অন্তর্গত। দেখা যায় যে, মানুষের মধ্যে উহার প্রত্যেকটি চিহ্নই বিদ্যমান। সুতরাং মানুষ যে প্রাইমেট, সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।