উক্তরূপে একটি অভিনব জন্তুর উদ্ভব হইলে, কালক্রমে উহারা আবার দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া পড়ে। উহাদের মধ্যে একটির লেজ নাই, মুখমণ্ডল ঈষৎ গোল, উহারা সোজা হইয়া হাঁটিতে পারে এবং যাবতীয় কাজে হাত ব্যবহার করে। এই জন্তুটি বানর নহে, শিম্পাঞ্জি, গরিলা বা ওরাংওটাং নহে এবং পুরাপুরি মানুষও নহে। ইংরাজিতে ইহাদিগকে বলা হয় অ্যানথ্রোপয়েড এপ বা মানুষসদৃশ বানর। ইহারাই মানুষের পূর্বপুরুষ। প্যারাপিথেকাসের অপর শাখার জন্ধুদের সাথে অ্যানথ্রোপয়েড এপ-এর চালচলন ও আকৃতিগত পার্থক্য সামান্য হইলেও তাহারা বনমানুষের পূর্বপুরুষ।[২৫]
ক্রমবিবর্তন কোনোটিই অল্প সময়ে হয় না। ক্ষুদ্র একবিন্দু প্রোটোপ্লাজম হইতে চোখের দেখায় চিনিতে পারার মতো জীবের সৃষ্টি হইতে, তুলতুলে শরীরে বর্মসাজ ও মেরুদণ্ড জন্মিতে সময় লাগিয়াছিল প্রায় একশত কোটি বৎসর এবং জলচর হইতে উভচর, স্থলচর, সরীসৃপ ও পশু (বানর) রূপ ধারণ করিয়া তাহার লেজ খসিতে সময় লাগিয়াছিল আরও প্রায় পঞ্চাশ কোটি বৎসর।
————
[২৪. পৃথিবীর ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃ. ১৯৪–১৯৮।
২৫. পৃথিবীর ঠিকানা, অমল দাসগুপ্ত, পৃ. ২১৮–২২৪।]
১০. আদিম মানবের সাক্ষ্য
আদিম মানবের সাক্ষ্য
প্রায় এক শতাব্দীকাল পর্যন্ত জীববিজ্ঞানীগণ চেষ্টা করিয়া আসিতেছেন মানুষের পূর্বপুরুষের নিদর্শন পাওয়ার জন্য এবং এ ব্যাপারে তাহারা কতক সাফল্যও লাভ করিয়াছেন। বিভিন্ন অঞ্চলের মাটি খুঁড়িয়া বিভিন্ন সময়ে যে সকল বিক্ষিপ্ত হাড়গোড় এবং আস্ত কঙ্কাল পাওয়া গিয়াছে, তাহা সুসংবদ্ধভাবে সাজাইয়া মানুষের বিবর্তনের একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস বিজ্ঞানীরা পাইয়াছেন। উহাতে দেখা যায় যে, হাল আমল হইতে যতই অতীতের দিকে যাওয়া যায়, মানুষের চেহারা ততই বুনো হইয়া দাঁড়ায় এবং যতই বর্তমানের দিকে আসা যায়, ততই বুনো হয় আধুনিক। দৃষ্টান্তস্বরূপ দেখানো যাইতে পারে –অস্ট্রালোপিথেকাস মানুষ, জাভা ও পিকিং মানুষ, নেয়ানডার্থাল মানুষ, ক্রোমাঞ মানুষ ইত্যাদি।
অস্ট্রালোপিথেকাস মানুষ— আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিম ট্রান্সভাল অঞ্চলে ১৯২৪ সালে একটি মাটির ঢিবিকে ডিনামাইট দিয়া উড়াইয়া দেওয়া হইয়াছিল। উহার নিচে আরও কিছু মাটি খুঁড়িয়া পাওয়া গিয়াছিল ছয় বৎসর বয়সের একটি ছেলের মাথার খুলি। উহার গড়ন ছিল বানর ও মানুষের মাঝামাঝি। খুলিটির বয়স ছিল এক লক্ষ বৎসরের কিছু বেশি। ইহাকে বলা হয় অস্ট্রালোপিথেকাস মানুষ।
১৯৩৬ সালে জোহানেসবার্গ-এর নিকটবর্তী স্থান হইতে মাটি খুঁড়িয়া আর একটি মাথার খুলি ও কিছু হাড়গোড় পাওয়া গিয়াছিল। এইগুলি ছিল একটি পূর্ণবয়স্ক মানুষের। এইটিও ছিল না। মানুষ, না বানর গোছের এবং অস্ট্রালোপিথেকাসের সমবয়সী ও সমগোত্রীয়।
১৯৩৮ সালে ঐ অঞ্চল হইতে আরও একটি মাথার খুলি ও কয়েকটি দাঁত এবং ১৯৪৭ সালে ঐ রকম আরও নিদর্শন পাওয়া গিয়াছিল। সবগুলিই ছিল মানুষ ও বানরের মাঝামাঝি চেহারার এবং প্রত্যেকের বয়সই ছিল লক্ষাধিক বৎসর।
জাভা ও পিকিং মানুষ –হল্যাণ্ডবাসী ইউজেন দুবোয়া নামক একজন ডাক্তার ১৮৯০-৯২ সালে জাভা দ্বীপের পূর্বার্ধে মাটি খুঁড়িয়া বিক্ষিপ্তভাবে পাইয়াছিলেন মানুষের একটি দাঁত সহ নিচের চোয়ালের একটি হাড়, উপরের চোয়ালের ডান দিকের একটি পেষণ দাঁত, মাথার খুলি ও উরুর একটি হাড়।
প্রোক্ত কঙ্কালগুলি পর্যবেক্ষণ করিয়া জীববিজ্ঞানীরা জানিয়াছেন যে, ব্রহ্মতালুটি বানরের মতো ও উরুর হাড় অবিকল মানুষের মতো। অর্থাৎ উহা আধা বানর ও আধা মানুষ। মাটির যে স্তরে ঐ কঙ্কালসমূহ পাওয়া গিয়াছে, তাহার পুরাতনত্বের হিসাবে ঐ কঙ্কালের বয়স এক লক্ষ হইতে তিন লক্ষ বৎসরের মধ্যে।
পিকিং শহরের নিকটবর্তী স্থান হইতে একজন জার্মান ডাক্তার ১৯০২ সালে আবিষ্কার করেন একটি দাঁত, ১৯১৬ সালে একজন জীববিজ্ঞানী ঐ অঞ্চলের মাটি খুঁড়িয়া প্রাপ্ত হন কতগুলি হাড়গোড়, ১৯২৭ সালে কানাডার একজন জীববিজ্ঞানী প্রাপ্ত হন একটি দাঁত এবং ঐ একই অঞ্চল হইতে একজন চীনা, একজন ফরাসী এবং একজন আমেরিকান জীববিজ্ঞানী খুঁজিয়া পান মাথার খুলি, চোয়ালের হাড় ও দাঁত ইত্যাদি। চেহারায় ঐ পিকিং মানুষগুলি জাভা মানুষের সমগোত্রীয় ও সমবয়সী। ইহারা না মানুষ, না বানর। অর্থাৎ মানুষ ও বানরের মাঝামাঝি চেহারা।
নেয়ানডার্থাল মানুষ –জার্মানীর ডুসেলডর্ফ ও এনবেরফেণ্ড-এর মাঝখানে নেয়ানডার্থাল নামক স্থানে ১৮৫৬ সালে মৃত্তিকা খনন করিয়া পাওয়া গিয়াছিল একটি মাথার খুলি। জীববিজ্ঞানীদের মতে খুলিটি মানুষের পূর্বপুরুষের। মাটির যে স্তরে ঐটি পাওয়া যায়, তাহার প্রাচীনত্বের হিসাবে ঐ খুলিটির বয়স ৭৫ হাজার বৎসর।
১৯০৮ সালের ৩ আগস্ট তারিখে ফ্রান্সের শাপেন ও-স্যা নামক গ্রামের কাছে একটি গুহা হইতে পাওয়া গিয়াছিল একটি আস্ত কঙ্কাল। এইটি পরীক্ষা করিয়া নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইয়াছে যে, এই কঙ্কালটি মানুষের। বিশেষত নেয়ানডার্থাল মানুষের সমবয়সী ও সমগোত্রীয়।
ঐ আস্ত ককালটি হইতে মানুষের একটি নিখুঁত ছবি পাওয়া গিয়াছে। মানুষটির মুণ্ড প্রকাণ্ড, ধড় ছোট, লম্বায় পাঁচ ফুট এক ইঞ্চি হইতে তিন ইঞ্চির মধ্যে। দুই পায়ে ভর দিয়া খাড়া হইয়া দাঁড়াইতে পারে, কিন্তু শরীর ও মাথা সামনের দিকে নুইয়া পড়ে, হাঁটু বাকিয়া যায়। শরীরের তুলনায় মুখ বড়, মাথার খুলি চ্যাটালো। অর্থাৎ মানুষ নহে, পুরাপুরি বানরও নহে। তবে মানুষের আদলটিই বেশি।