অন্যান্য জীবদের বেলায় যাহাই ঘটিয়া থাকুক না কেন, স্তন্যপায়ীরা দুইটি বড় রকম সুবিধা পাইয়াছিল, যাহা অন্যান্য জীবদের ভিতর ছিল না। প্রথমত উষ্ণ রক্তের অধিকারী হওয়ায় স্তন্যপায়ী জীবেরা শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা বা যে কোনো রকম প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াইয়া নিতে পারিয়াছিল। দ্বিতীয়ত স্তন্যপায়ীদের সন্তানবাৎসল্য ছিল। অন্যান্য জীবদের মধ্যে এই দুইটির একটিও ছিল না। কাজেই অন্যান্য জীবগণকে পিছনে ফেলিয়া স্তন্যপায়ীরা উন্নতির পথে আগাইয়া চলিয়াছিল।
গ. নবজীবীয় যুগ (Caino zoic) আজ হইতে ৭ কোটি বৎসর পূর্বে এয়োসেন উপযুগের প্রথমেই দেখা যায় যে, স্তন্যপায়ী জীবগণ বহু শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হইয়া অধিকাংশ ভূভাগ জুড়িয়া বসবাস করিতেছে। ঐ যুগের স্তন্যপায়ীগণ আকারে এখনকার স্তন্যপায়ী জীবের চেয়ে ছোট ছিল। বর্তমান যুগের হাতি, ঘোড়া, শূকর, গণ্ডার ইত্যাদি প্রাণীদের আদিপুরুষ ছিল একটি স্তন্যপায়ী জীব, উহার নাম ফেনাডোকাস। আকারে ইহা শিয়ালের চেয়ে বড় ছিল না।
হিংস্র ও মাংসাশী একদল স্তন্যপায়ী জীব ছিল, যাহার নাম ক্রিয়োডোন্ট। কালক্রমে এই ক্রিয়োডোন্টরা দুই দলে ভাগ হইয়া যায়। এক দলের চেহারা ছিল কুকুরের মতো, ইহাদের ক্রমবিবর্তনে কুকুর, নেকড়ে বাঘ, ভালুক ইত্যাদি এবং আর এক দলের চেহারা ছিল বিড়ালের মতো, ইহাদের ক্রমবিবর্তনে জন্মিয়াছে বিড়াল, বাঘ, সিংহ ইত্যাদি।
অন্যান্য স্তন্যপায়ীদের মধ্যে ছিল এক প্রকার ক্ষুদে ক্ষুদে জীব। ইহারা গাছে চড়িতে পারিত। ও ডালে ডালে লাফালাফি করিত।
নবজীবীয় যুগের প্রথম পর্বের সকল স্তন্যপায়ী জীব আজ বর্তমান নাই। কোনো কোনো দল লুপ্ত হইয়া গিয়াছে, আবার কোনো কোনো নূতন দলের আবির্ভাব ঘটিয়াছে। সাত কোটি বৎসর লাগিয়াছে উহাদের বর্তমান আকারে পৌঁছিতে।
যে সকল জীব মাটিতে, বিশেষত বনে-জঙ্গলে চলাফেরা করে, তাহাদের দৃষ্টিশক্তির চেয়ে ঘ্রাণশক্তি বেশি। কেন না, ঝোঁপ-জঙ্গলের বাধাজনিত কারণে দৃষ্টিশক্তি তত বেশি কাজে লাগে না। অদূরে ঝোঁপের আড়ালে কোনো শিকার থাকিলে ঘ্রাণের সাহায্যে তাহার অবস্থিতি জানিয়া তাহাকে আক্রমণ করিতে হয়। অথবা কোনো হিংস্র প্রাণী থাকিলেও তাহা ঘ্রাণের সাহায্যে জানিয়া পলাইবার চেষ্টা করিতে হয়। অর্থাৎ আক্রমণ ও আত্মরক্ষা উভয়ের জন্যই ঘ্রাণশক্তি প্রখর হওয়া দরকার। কিন্তু বৃক্ষারোহী জীবদের ঘ্রাণশক্তি বিশেষ কোনো কাজেই আসে না। তাহাদের চাই প্রখর দৃষ্টিশক্তি। এক ডাল হইতে লাফাই আরেকটি ডাল ধরিতে হইলে চাই লক্ষ্যস্থলের দূরত্ব। ও অবস্থান সঠিকভাবে নির্ণয় করা, অন্যথায় জীবন বিপন্ন হইতে পারে। এইরূপ ক্রমিক চেষ্টার ফলে বৃক্ষারোহী জীবদের দৃষ্টিশক্তি উন্নততর হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে চক্ষু ও অক্ষিগোলকের অবস্থান পালটাইয়া যায়। অন্যান্য প্রাণীরা দুই চক্ষুতে একটি বস্তুর দুইটি ছবি দেখে। কিন্তু বৃক্ষরাহীদের চক্ষুর অবস্থান পরিবর্তিত হইয়া এরূপ হইল যে, উহারা দেখে একটি। ইহাতে লক্ষ্যভ্রষ্ট হইবার সম্ভাবনা কম।
চতুষ্পদ জন্তুর চারিটি পা-ই ব্যবহার করিতে হয় হাঁটার জন্য। কিন্তু বৃক্ষারোহীদের শাখা হইতে শাখান্তরে লাফালাফি করিতে সামনের পা দুইটি ব্যবহার করিতে হয় ধরার জন্য। এইরূপে উহাদের সামনের পা দুইটি হইল থাবা।
বৃক্ষারোহীদের আরো কয়েকটি বিষয়ে অভিজ্ঞতালাভ হইয়াছিল। ডালে ডালে লাফালাফি করিবার কালে প্রতি মুহূর্তে কর্তব্য নির্ধারণ অর্থাৎ লক্ষ্য স্থির করার জন্য দ্রুত মস্তিষ্ক চালনা। করিতে করিতে মস্তিষ্ক বড় হইতেছিল। অভিজ্ঞতাবৃদ্ধির সাথে সাথে পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়া হাঁটায় অভ্যস্ত হইয়াছিল এবং থাবা দুইটি ব্যবহার করিতে আরম্ভ করিল আক্রমণ ও আত্মরক্ষার জন্য।
দুই পায়ে চলাফেরায় সুবিধা অনেক। ইহাতে সামনের পা দুইটি সব সময়ই থাকে মুক্ত। প্রথমত আঁচড়াইয়া-কামড়াইয়া শিকার ধরা বা আক্রমণকারী শত্রুর কবল হইতে রক্ষা পাওয়ার অপেক্ষা ডালপালার (লাঠির) ব্যবহার বহুগুণে উত্তম। দ্বিতীয়ত মুখের সাহায্যে খাদ্য আহরণের চেয়ে থাবার সাহায্যে খাদ্যদ্রব্য তুলিয়া মুখে দেওয়ায় শ্রান্তি কম এবং শান্তি বেশি। এইরূপ নানাবিধ সুবিধা পাইয়া একদল বৃক্ষারোহী জীব পুরামাত্রায় দ্বিপদ হইয়া উঠিল এবং উহাদের থাবা দুইটি পরিণত হইল হাতে।
থাবা ব্যবহার করে না, মুখের সাহায্যেই খাবার তুলিয়া লয় –এইরূপ চতুষ্পদ জন্তুদের প্রায় সকলেরই মুখমণ্ডল হয় লম্বাটে। যথা –গরু, ঘোড়া, শিয়াল, কুকুর ইত্যাদি। আর যাহারা থাবা ব্যবহার করে, এইরূপ জন্তুদের প্রায়ই মুখমণ্ডল হয় গোল। যথা –বাঘ, বিড়াল, সিংহ ইত্যাদি। দ্বিপদ জন্তুরা খাবার তুলিয়া মুখে দেওয়া ও মশা-মাছি তাড়াইবার কাজে হাত ব্যবহার করিতে আরম্ভ করিলে, তাহাদের মুখমণ্ডল হইতে থাকে গোল এবং মশা মাছি তাড়ানো ও ধূলাবালি ঝাড়া ইত্যাদি কোনো কাজে লেজের ব্যবহার না থাকায় লেজটি হইতে থাকে ছোট। কালক্রমে উহাদের মেরুদণ্ডের শেষ প্রান্তে সামান্য একটু নমুনা ছাড়া লেজের আর কোনো চিহ্নই। থাকিল না। ইহাদের বলা হয় প্যারাপিথেকাস।