বর্মধারী জীব যথা –কাকড়া, কাছিম, শামুকাদি জীবেরা যত সহজে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করিতে পারে, চর্মধারী জীবেরা তত সহজে আত্মরক্ষা করিতে পারে না। তাই আত্মরক্ষার তাগিদে দ্রুত চলাচলের জন্য চমধারী জীবের দেহে তৈয়ার হয় মেরুদণ্ড। আজ হইতে প্রায় ৩৫ কোটি বৎসর পূর্বে অর্ডোভিসিয়ান উপযুগের শেষের দিকে প্রথম মেরুদণ্ডবিশিষ্ট যে সকল জীবের জন্ম হয়, তাহাদিগের এক দলকে বলা হয় মাছ।
মাছেরা সচরাচর কানকোর সাহায্যেই জল হইতে বাতাস সংগ্রহ করিয়া শ্বাসকার্য চালাইয়া থাকে। কিন্তু কালক্রমে কোনো কোনো মাছের আবার ফুসফুস গঠিত হইয়াছিল। এই ধরণের মাছ এখনও দেখিতে পাওয়া যায় আফ্রিকার সাগরে, যেমন– কোয়েলাকান্থ মাছ। ফুসফুসওয়ালা মাছেরা ডাঙ্গায় উঠিয়া পড়িলেও মারা যায় না, জল ও স্থল উভয় স্থানেই বাঁচিয়া। থাকিতে পারে।
যে সকল মাছ সমুদ্র উপকূলের কাছাকাছি বাস করিত, ঢেউয়ের আঘাতে বা জোয়ারের জলের সাথে তাহাদের কেহ কেহ ডাগায় উঠিয়া পড়িত। ইহাদের অনেকেই মরিয়া যাইত, কিন্তু সকলেই মরিত না। পরবর্তী ঢেউয়ের বা জোয়ারের জল আসা পর্যন্ত বাঁচিয়া থাকিতে পারিত। এইভাবে যে সকল মাছ জল ও ডাগায় বাঁচিয়া থাকার শক্তি অর্জন করিল, তাহারা হইল উভচর প্রাণী। ইহাদের বংশধর আজিকার কুমির, ব্যাঙ ইত্যাদি। উভচরদের সকলেরই ডাঙ্গার জীবন পছন্দ হয় নাই। কতক উভচর জন্তু আবার জলে বাস করিতে আরম্ভ করে। তাহাদের বর্তমান বংশধর তিমি, শুশুক ইত্যাদি।
উভচরদের কোনো কোনো শাখা স্থায়ীভাবে স্থলে বাস করিতে আরম্ভ করে। পরিবেশ পরিবর্তনের সাথে সাথে তাহাদের শরীরের নানা পরিবর্তন দেখা দেয়। তাহাদের লেজ আর চ্যাপ্টা থাকিল না, শল্ক হইল পশম এবং পাখনা হইল পা। এইভাবে ২৮ কোটি বৎসর পূর্বে। উভচর মৎস্যদের যে দলটি স্থায়ীভাবে ডাঙ্গাবাসী হইল, তাহাদের নাম হইল সরীসৃপ। জীব সৃষ্টির আদি হইতে আজ পর্যন্ত যত রকম জীব জন্মিয়াছে, তন্মধ্যে এই সরীসৃপরাই অতি বৃহৎ ও ভয়ানক। এই বিষয় পরে আলোচিত হইবে।
পুরাজীবীয় যুগের শেষ ভাগে ভূপৃষ্ঠে উদ্ভিদের সাতিশয় সমৃদ্ধি হইয়াছিল। সমুদ্রতীর ও জলাভূমিতে জন্মিয়াছিল নিবিড় অরণ্য। ভূপৃষ্ঠের আলোড়নে সেই নিবিড় অরণ্য মাটির নিচে চাপা পড়িয়া অত্যধিক চাপ ও তাপের প্রভাবে রূপান্তরিত হইয়াছে কয়লায়। এই কারণে এই যুগটির নামকরণ হইয়াছে কার্বনিফেরাস। আজকাল আমরা যে পাথর কয়লা ব্যবহার করিয়া থাকি, তাহা এই যুগের অর্থাৎ ২৮ কোটি বৎসর আগের বৃক্ষদের দেহের ধ্বংসাবশেষ বা ফসিল।
খ. মধ্যজীবীয় যুগ (Mesozoic) এই যুগের গাছপালা, জীবজন্তু সবই ছিল অতিকায়। জীবজন্তুর মধ্যে সরীসৃপরাই ছিল সংখ্যায় বেশি এবং বিশালাকার। তাই এই যুগটিকে সরীসৃপদের যুগও বলা যায়। এই যুগটি ১৯ কোটি বৎসর আগে আরম্ভ হইয়া শেষ হইয়াছে ৭ কোটি বৎসর আগে।
এই যুগের নানাবিধ সরীসৃপের মধ্যে যে শ্রেণীর সরীসৃপেরা প্রাধান্য লাভ করিয়াছিল, তাহাদিগকে বলা হয় ডাইনোসর। এই ডাইনোসরের আবার কয়েকটি প্রকারভেদ আছে। যথা –ব্রন্টোসরাস, ট্রাইনোসরাস, অল্লোসরাস, গোগোসরাস, সেরাটোসরাস, স্টেগোসরাস ইত্যাদি।
একটি ব্রন্টোসরাসের দৈর্ঘ্য ছিল অন্তত ২৫ গজ এবং উহার ওজন ছিল ৫০ টন, অর্থাৎ ১,৩৫০ মণ। একটি ট্রাইরানোসরাসের ওজন ছিল প্রায় ১০ টন এবং লম্বায় ছিল ৫০ ফিটেরও বেশি।
আকৃতি ও প্রকৃতিতে পার্থক্য থাকিলেও ঐসকল সরীসৃপদের কতক বিষয়ে মিল ছিল। উহারা সকলেই পিছনের বিরাট পা ও লেজের উপর ভর দিয়া ছুটিত, সামনের ক্ষুদে ক্ষুদে থাবা দুইটি ব্যবহার করিত একমাত্র খাবার ও লড়াইয়ের জন্য এবং উহারা সকলেই ছিল মাংসাশী।
একদল সরীসৃপ আকাশে উড়িতে শুরু করিয়াছিল। ইহাদের বলা হয় টেরোডাকটিল। ইহাদের গায়ে পালক বা পশম ছিল না, ছিল শুধু চামড়ার ডানা ও ধারালো দাঁতওয়ালা মুখ (কতকটা বাদুড়ের ন্যায়)। মধ্যজীবীয় যুগের শেষের দিকে ক্রেটাশিয়াস উপযুগে, অর্থাৎ প্রায় ৮ কোটি বৎসর আগে টেরোডাকটিলেরা এইরূপ বিশালকায় হইয়াছিল যে, এক ডানার প্রান্ত হইতে আর এক ডানার প্রান্তের মাপ ছিল ২৫ ফিট। এই উড়ন্ত সরীসৃপরাই ছিল আধুনিক পাখির পূর্বপুরুষ। একই যুগেই দেখা যায় যে, ঐ উড়ন্ত সরীসৃপদের রূপান্তর হইতে আরম্ভ করিয়াছে এবং উহাতে পাখির লক্ষণ দেখা দিয়াছে। এইরূপ আর একটি উড়ন্ত জীব আর্কিওপটেরিক। এইটি পাখি ও সরীসৃপের মিশ্ররূপ — আধা পাখি, আধা সরীসৃপ।
আধুনিক সাপ, কুমির, গিরগিটি ইত্যাদির মতো সেই যুগের সরীসৃপরা ছিল ডিম্বপ্রসূ জীব। কিন্তু দেখা যায় যে, ট্রিয়াসিক উপযুগে অর্থাৎ আজ হইতে প্রায় ১৫ কোটি বৎসর আগে একদল ক্ষুদে ক্ষুদে জীব ডিম্ব প্রসব না করিয়া গর্ভধারণ ও বাচ্চা প্রসব করিত। এই সময় হইতেই স্তন্যপায়ী জীবের আবির্ভাব হয়। বিশেষত সরীসৃপদের রক্ত ছিল ঠাণ্ডা, কিন্তু স্তন্যপায়ীদের রক্ত গরম।
মধ্যজীবীয় যুগের শেষের দিকে ক্রেটাশিয়াস উপযুগে ব্রন্টোসরাসাদি কোনো জাতের ডাইনোসরের চিহ্ন (ফসিল) পাওয়া যায় না। এইরূপ অতিকায়, মহাশক্তিশালী একটি জীবের সম্পূর্ণ জাতি ধ্বংস হওয়ার কারণ লইয়া জীববিজ্ঞানীদের অনেক আলোচনা চলিতেছে। কেহ বলেন, “বিপ্লব বা যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ডাইনোসরদের দৈহিক পরিবর্তন না হওয়ায় ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াইয়া চলিতে না পারায় ডাইনোসরেরা বংশরক্ষা করিতে পারে নাই।” কেহ বলেন, “মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে যেরূপ যৌবন ও বার্ধক্য আছে এবং বার্ধক্যে সন্তানোৎপাদিকা শক্তি থাকে না বা কমিয়া যায়, প্রত্যেক জীবের জাতিগত জীবনেও তদ্রুপ বার্ধক্য আছে এবং জাতিগত জীবনের বার্ধক্যেও ঐ জাতির সন্তানোৎপাদিকা শক্তি থাকে না বা কমিয়া যায়। মধ্যজীবীয় যুগের সরীসৃপ তথা ডাইনোসরদের জাতিগত জীবনের বার্ধক্য হেতুই উহারা সবংশে লুপ্ত হইয়া গিয়াছে।” ভূপৃষ্ঠে ডাইনোসরের একাধিপত্য ছিল প্রায় ১০ কোটি বৎসর।