কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে সোমবারে ত্রেতা যুগের উৎপত্তি। এই যুগের পরিমাণ ১২,৯৬,০০০ বৎসর। ত্রেতায় বামন, পরশুরাম, শ্রীরামচন্দ্র –এই তিন অবতার। এই যুগে। ককুস্থ, ত্রিশঙ্কু, হরিশচন্দ্র, মরুত্ত, অনরণ্য, সগর, অংশুমান, রঘু, অজ, দশরথ প্রভৃতি রাজা রাজত্ব করিয়াছিলেন। এই সময় লোকের পরমায়ু ছিল দশ সহস্র বৎসর এবং দেহ ছিল চতুর্দশ হস্ত পরিমিত।
ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে বৃহস্পতিবারে দ্বাপর যুগের আরম্ভ হয়। এই যুগের পরিমাণ ৮,৬৪,০০০ বৎসর। এই যুগে বলরাম ও বুদ্ধ –এই দুই অবতার। শাল, বিরাট, ময়ূরজ, শান্তনু, দুর্যোধন, যুধিষ্ঠির, জরাসন্ধ প্রভৃতি এই যুগের রাজা ছিলেন। এই কালে মানুষের সহস্র বৎসর পরমায়ু ও সপ্ত হস্ত পরিমিত দেহ ছিল।
মাঘী পূর্ণিমায় শুক্রবারে কলিযুগের উৎপত্তি হয়। এই যুগের পরিমাণ ৪,৩২,০০০ বৎসর। এই যুগের শেষভাগে কল্কি অবতার আবির্ভূত হইবেন। এই সময়ে মানুষের পরমায়ু ১২০ বৎসর এবং দেহ সার্ধ-ত্রিহস্ত পরিমিত। এই যুগের মাত্র ৫,০৭০ বৎসর গত হইয়াছে (বাংলা ১৩৭৭ সন পর্যন্ত)।
উল্লিখিত চারি যুগের শাস্ত্রীয় বিবরণের সমালোচনা বা সত্যাসত্য যাচাই করা আমাদের উদ্দেশ্য নহে, উহা যুগমানবের কর্তব্য। আলোচ্য যুগচতুষ্টয়ের মোট বয়স ৪৩,২০,০০০ বৎসর এবং কলিযুগের শেষ হইতে এখনও ৪,২৬,৯৩২ বৎসর বাকি। সুতরাং অতীত হইয়াছে ৩৮,৯৩,০৬৮ বৎসর। কলিযুগের অবসানে কোন্ যুগ আসিবে এবং সত্যযুগের পূর্বে কোনোও জীব বা যুগ ছিল কিনা, শাস্ত্রকার তাহার কোনো ইঙ্গিত দেন নাই। আলোচ্য যুগচতুষ্টয়ের অতীত কাল বিজ্ঞানীদের সর্বাধুনিক প্লিটোসেন উপযুগটির সমানও নহে (এই যুগটির বর্তমান বয়স প্রায় ৫০ লক্ষ বৎসর)। পক্ষান্তরে বাইবেলের মতে, বিশ্বের সৃষ্টি বা মানুষের সৃষ্টি হইয়াছে খ্রী. পূ. ৪০০৪ সালে। অর্থাৎ এখন (১৯৭০) হইতে ৫,৯৭৪ বৎসর আগে।
উপরোক্ত যুগচতুষ্টয়ের বয়সের হিসাবে দেখা যায় যে, মোট বয়সের ১০ ভাগের ৪ ভাগ সত্য যুগ, ৩ ভাগ ত্রেতা যুগ, ২ ভাগ দ্বাপর যুগ এবং ১ ভাগ কলির ভাগে পড়িয়াছে। অর্থাৎ কলির বয়সের দ্বিগুণ দ্বাপর, তিন গুণ ত্রেতা, এবং চারি গুণ পড়িয়াছে সত্য যুগের ভাগে। এইরূপ আঙ্কিক যুগবিভাগ বিজ্ঞানীগণ করেন না, তাঁহাদের যুগবিভাগ অন্য রকম।
প্রত্নতত্ত্ববিদগণ ভূগর্ভের স্তরগুলিকে কালক্রমিক কতগুলি ভাগে বিভক্ত করিয়াছেন। উহার এক একটি ভাগকে বলা হয় এক একটি যুগ। এখন হইতে পঞ্চাশ কোটি বৎসর আগের সমস্ত যুগকে একত্রে বলা হয় আর্কেও জোইক (Archaeo Zoic) মহাযুগ বা প্রাক-ক্যামব্রিয়ান যুগ। এই যুগে যে সমস্ত প্রাণী বর্তমান ছিল, তাহাদের অস্তিত্বের সন্ধানটুকু পাওয়া যায় মাত্র, বিশেষভাবে কিছু। জানার উপায় নাই। যেহেতু তাহাদের দেহ ছিল নরম তুলতুলে, দেহে আবরণ বলিতে কিছু ছিল না। তাই তাহাদের কোনো ফসিল ভূগর্ভে পাওয়া যায় না।
ক্যামব্রিয়ান যুগ আরম্ভ হইবার পর হইতে কোনো কোনো প্রাণীদেহ কঠিন খোলস বা বর্মে আবৃত হয়। যেমন– চিংড়ি, কাঁকড়া ইত্যাদি। এই সময় হইতেই শিলালিপি বা ফসিল প্রাপ্ত হওয়া যায়। জীববিজ্ঞানীগণ যে সময় হইতে ফসিল বা শিলালিপির সাহায্যে জীবজগতের ইতিহাস জানিতে পারেন, সেই সময়টিকে তাঁহারা বলেন ঐতিহাসিক যুগ। এই ঐতিহাসিক যুগটিকে আবার তিন পর্যায়ে ভাগ করা হইয়াছে। যথা –পুরাজীবীয় (Palaeo Zoic), মধ্যজীবীয় (Meso Zoic) ও নবজীবীয় (Caino Zoic) যুগ। এই তিনটি যুগের ব্যাপ্তি ৫০ কোটি বৎসর। ইহার মধ্যে পুরাজীবীয় যুগ ৩১ কোটি বৎসর। ইহা ৫০ কোটি বৎসর আগে আরম্ভ হইয়া শেষ হইয়াছে ১৯ কোটি বৎসর আগে। এই যুগটির ৬টি উপযুগ আছে। মধ্যজীবীয় যুগটির ব্যাপ্তি ১২ কোটি বৎসর। ইহা ১৯ কোটি বৎসর আগে আরম্ভ হইয়া শেষ হইয়াছে ৭ কোটি বৎসর আগে। এই যুগটির তিনটি উপযুগ আছে। নবজীবীয় যুগ অর্থাৎ বর্তমান যুগটি মাত্র ৭ কোটি বৎসর আগে আরম্ভ হইয়া এখনও চলিতেছে। ইহার ৫টি উপযুগ আছে। সর্বশেষ উপযুগটির নাম প্লিসটোসেন উপযুগ। এই যুগটি ৫০ লক্ষ বৎসর আগে আরম্ভ হইয়া এখনও চলিতেছে। জীবজগতের বিবর্তন বিশেষত মানুষ জাতির বিবর্তনের ক্ষেত্রে এই প্লিসটোসেন উপযুগটির গুরুত্ব অপরিসীম। বিবর্তনের ক্রমিক ধারা হৃদয়ঙ্গম করিতে হইলে যুগ ও উপযুগগুলি সম্বন্ধে মোটামুটি একটি ধারণা থাকা আবশ্যক। এইখানে স্তরক্ৰমিক যুগের একটি তালিকা দেওয়া হইল। উহা পাঠকের বিবর্তনবাদ বুঝিবার সহায়তা করিবে।
স্তরক্রমিক যুগবিভাগ (সাম্প্রতিক হইতে অতীতে)
ক. পুরাজীবীয় যুগ (Palaeo Zoic) এই যুগের প্রথমে ভূপৃষ্ঠে যে স্তরের সৃষ্টি হইয়াছিল, তাহা পর্যবেক্ষণ করিয়া বিজ্ঞানীগণ স্থলভাগে কোনো জীবের অস্তিত্ব পান নাই, সমুদ্রে পাইয়াছেন জলজ উদ্ভিদ ও আলপিনের মাথার মতো ক্ষুদ্র এক জাতীয় পোকা, উহাদের বলা হয় ট্রাইলোবাইট। কয়েক কোটি বৎসর পর দেখা যায় যে, ঐ পোকার আকার হইয়াছে প্রায় এক ফুট। বর্তমানে উহার সকল শাখাই বাঁচিয়া নাই। যে দুই একটি দল বাঁচিয়া আছে, খুব সম্ভব তাহারা উহাদের বংশধর কাঁকড়া, গলদা চিংড়ি ইত্যাদি।
ট্রাইলোবাইটদের এক দল নদী বা হ্রদে আশ্রয় লয়। ইহাদের নাম ইউরীপটেরিড়। ভূপৃষ্ঠের আলোড়নে নদী বা হ্রদ শুকাইয়া গেলে উহাদের বেশির ভাগই মারা পড়ে, কৃতক সমুদ্রে চলিয়া যায় এবং কোনো কোনো দল শুকনায়ও বাঁচিয়া থাকে। ইহাদের পরিবর্তিত রূপ বৃশ্চিক, মাকড়সা ইত্যাদি এবং কেহ কেহ উড়িবার ক্ষমতা লাভ করিয়া হয় পতঙ্গ। যাহারা সমুদ্রে চলিয়া যায়, কয়েক কোটি বৎসরের মধ্যে তাহাদের দেহ হয় খোলস বা চর্মে আবৃত (বর্ম নহে)।