পলিনেশীয়দের মত
পলিনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জে বিভিন্ন জাতির মধ্যে সৃষ্টি সম্বন্ধে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে। স্যার জর্জ গ্রে পলিনেশিয়ার পৌরাণিক বৃত্তান্ত সংগ্রহ করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার এবং অন্যান্য গ্রন্থকারগণের বর্ণনায় প্রকাশ, পলিনেশিয়ার মাওয়ারী জাতির বিশ্বাস—‘রাঙ্গী’ ও ‘পাপা’ অর্থাৎ স্বর্গ ও পৃথিবী প্রথমে একত্রে সংযুক্ত ছিল। সহসা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়ায় স্বর্গ উপরে চলিয়া যায়, পৃথিবী নিম্নে পড়িয়া থাকে (‘স্বর্গ উপরদিকে’—এই মতটি ধর্মজগতের বহুক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থিত)। মাওয়ারীগণ বলে, রাঙ্গী ও পাপার পুত্রের নাম তাঙ্গালোয়া বা তারোয়া। তিনি জনদেবতা, সমুদ্রের অধিপতি। তিনি মৎস্য ও সরীসৃপকূল সৃষ্টি করেন। পলিনেশিয়ার অন্যান্য অংশের অধিবাসীরা আবার তাঙ্গালোয়াকেই অদ্বিতীয় পরমেশ্বর বলিয়া স্বীকার করে। তাহাদের মতে, তিনিই সৃষ্টিকর্তা। শ্যামোয়া দ্বীপে তাহার নাম তাঙ্গালোয়ালাঙ্গী। তাঙ্গালোয়া ও লাঙ্গী এই উভয় শব্দেই স্বর্গকে বুঝাইয়া থাকে। মেঘমণ্ডলকে তাহারা তাঙ্গালোয়ার পোত বা তরণী বলিয়া বিশ্বাস করে। কখনও কখনও তাঙ্গালোয়া শম্বুকের মধ্যে বাস করেন বলিয়া প্রবাদ আছে। সময় সময় তাঙ্গালোয়া আপনার অধিষ্ঠানভূত শম্বুকটিকে পরিত্যাগ করিতেন, তদ্বারা পৃথিবীর অবয়ব ও প্রাণীসংখ্যা বৃদ্ধি পাইত। আবার কোনো কোনো স্থানে প্রচার, তাঙ্গালোয়া ডিম্বের মধ্যে বাস করিতেন, তদ্বারা দ্বীপসমূহের উৎপত্তি হইত।
পলিনেশিয়ায় তাঙ্গালোয়া সম্বন্ধে আর একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে—অতি প্রাচীনকালে তাঙ্গালোয়া এক বৃহদকার পক্ষীরূপে সমুদ্রের উপর বিচরণ করিতেন। সেই সময় তিনি জলের উপর একটি ডিম্ব রক্ষা করেন। সেই ডিম্বই পৃথিবী ও স্বর্গ অথবা সূর্য।
নিউজিল্যাণ্ড দ্বীপের অধিবাসীরা তাঙ্গালোয়ার প্রাধান্য স্বীকার করে না। তাহাদের মতে, ‘মানি’ অদ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তা ও পরমেশ্বর। তিনি প্রথমে বায়ু ও বন্যা সৃষ্টি করেন। তাহা হইতে অন্যান্য পদার্থ উদ্ভূত হয়। দেবগণের উৎপত্তি সম্বন্ধে পলিনেশিয়াবাসীগণ সাধারণত বলিয়া থাকে যে ‘পো’ হইতে দেবগণের উদ্ভব হইয়াছে। ‘পো’ শব্দে অন্ধকার বুঝায়। সে হিসাবে অন্ধকারই সকলের জনয়িতা। এমনকি তাঙ্গালোয়া পর্যন্ত অন্ধকার হইতে উদ্ভূত হইয়াছিলেন।(১)
————————-
১. রচনা সংগ্রহ – রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী
০২. ধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্ব
ধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্ব
# বৈদিক ধর্ম
বেদ-বিধানাত্মক ধর্মই বৈদিক ধর্ম। বৈদিক ধর্মের বর্তমান নাম হিন্দুধর্ম। বেদ চারিখানা। যথা –ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব। বেদ রচিত হইবার বহু পরে উহার ভাষ্য-অনুভাষ্য, টীকা ইত্যাদি এবং পুরাণ, উপপুরাণ, গীতা, তন্ত্র ইত্যাদি অজস্র শাস্ত্রগ্রন্থ রচিত হইয়া উহা বৈদিক ধর্মে গৃহীত হইয়াছে। সেই সবের মধ্যে কয়েকখানা গ্রন্থের সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধীয় মতবাদ এইখানে আলোচিত হইল।
ঋগ্বেদ (পুরুষ সুক্ত) – “পুরুষ (ঈশ্বর) সহস্র মস্তকযুক্ত এবং সহস্র অক্ষি ও সহস্র পদ বিশিষ্ট। তিনি বিশ্বচরাচর সর্বত্র পরিব্যাপ্ত ও দশদিকে বিরাজমান (১)। যাহা উৎপন্ন হইয়াছে, যাহা উৎপন্ন হইবে, সকলই সেই পুরুষ। তিনি অমরত্বের অধিকারী। তিনি অন্নের (ভাতের) দ্বারা পরিপুষ্ট (২)। সেই পুরুষের মহিমার অন্ত নাই। তাহার এক পদে ভূতসমষ্টিপূর্ণ এই পৃথিবী এবং অপর তিন পদে অমরগণ পরিপূরিত স্বর্গ (৩)। তিনি চেতন, অচেতন সকল সামগ্রীতেই পরিব্যাপ্ত। তাহা হইতেই বিরাট জন্মগ্রহণ করেন। বিরাট হইতে আবার পুরুষ উৎপন্ন হ’ন (৪)। তিনি জন্মমাত্র অগ্রপশ্চাতে ব্যস্ত হইয়া পড়েন; সেই পুরুষকেই হব্যরূপে গ্রহণ করিয়া দেবতারা যজ্ঞ করিয়াছিলেন। তখন বসন্ত ঘৃত হইয়াছিল, গ্রীষ্ম যজ্ঞকাষ্ঠ এবং শরৎ হবি হইয়াছিল (৫)। সেই যজ্ঞাগ্নি হইতে জল এবং খেচর ও ভূচর, আরণ্য ও গ্রাম্য পশু উৎপন্ন হইল (৬)। সেই যজ্ঞ হইতে ঋক, সাম উৎপন্ন হইল; ছন্দসকল আবির্ভূত হইল; যজু উৎপন্ন হইল (৭)। তাহা হইতে অশ্ব উৎপন্ন হইল এবং দুই পাটি দন্তযুক্ত পশুগণ জন্মগ্রহণ করিল। তাহা হইতে গো-গণ জন্মগ্রহণ করিল, তাহা হইতে ছাগ ও মেষ উৎপন্ন হইল (৮)। সেই পুরুষ বিভক্ত হইলে … তাঁহার মুখ হইতে ব্রাহ্মণ, বাহু হইতে ক্ষত্রিয়, উরু হইতে বৈশ্য এবং পদদ্বয় হইতে শূদ্রের উৎপত্তি হয় (৯)। তাহার মন হইতে চন্দ্র, চক্ষু হইতে সূর্য, মুখ হইতে ইন্দ্র ও অগ্নি এবং প্রাণ হইতে বায়ু বা জীবের প্রাণবায়ু উৎপন্ন হইয়াছিল (১০)। তাহার নাভি হইতে অন্তরীক্ষ, মস্তক হইতে স্বর্গ, চরণদ্বয় হইতে ভূমি, কর্ণ হইতে দিকসকল ও লোকসমূহ উৎপন্ন হয় (১১)।” ইত্যাদি।
শতপথ ব্রাহ্মণ (৬/১/১) –“পুরুষ প্রজাপতি প্রথমে জলের সৃষ্টি করিয়া জলমধ্যে আপনি অণ্ডরূপে প্রবিষ্ট হন। সেই অণ্ড হইতে জন্মগ্রহণ করিবার জন্যই তিনি তাহাতে প্রবেশ করিয়াছিলেন। পরিশেষে তিনি তাহা হইতে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টিকারী ব্রহ্মরূপে আবির্ভূত হন।”
অথর্ব সংহিতা (১১/৪) — “প্রাণ হইতেই অর্থাৎ প্রাণস্বরূপ পরমেশ্বর হইতেই বিশ্বের উৎপত্তি হয়, পরমেশ্বর স্বয়ংই প্রথমসৃষ্টরূপে আবির্ভূত হন।”
তৈত্তিরীয় উপনিষদ (২/৬) –“ব্ৰহ্ম ইচ্ছা করিলেন, আমি বহু হইব, বহুরূপে প্রকাশমান হইব। অতঃপর তিনি তপস্যায় প্রবৃত্ত হন। সেই তপস্যার ফলে পরিদৃশ্যমান বিশ্বের সৃষ্টি হয়। বিশ্ব সৃষ্টি করিয়া তিনি স্বয়ং তাহার মধ্যে প্রবেশ করেন এবং সর্বরূপে আবির্ভূত হন।”