আদিম জীবকোষের বংশাবলী আজও দেখা যায় খাল-বিলের নোংরা জলে। উহা নরম তুলতুলে জেলির মতো শেওলা জাতীয় এক প্রকার জলো পদার্থ। অণুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা দেখিলে উহাতে দেখা যায় অসংখ্য বিন্দু বিন্দু জীবকোষ। ইহাদের বলা হয় অ্যামিবা। ইহারাই জীবজগতের আদিম প্রাণী এবং এককোষবিশিষ্ট জীব।
কালক্রমে কোনো কোনো জীবকোষ একা একা না থাকিয়া মধুপোকার মতো কতগুলিতে একত্র জটলা করিয়া থাকিতে আরম্ভ করে। জটলার বাহিরের দিকের কোষগুলি খাদ্য সংগ্রহ করিলে ভিতরের কোষগুলি উহা চুষিয়া লয় এবং স্বস্থানে থাকিয়া উহাদের পুষ্টি ও বংশবৃদ্ধি হইতে থাকে। ইহার ফলে জটলাটির কলেবর বৃদ্ধি পায়। জটলার ভিতরের কোষগুলির স্বতন্ত্র সত্তা বজায় থাকে, কিন্তু বাহিরে হইয়া যায় এক। এইভাবে নানা আকৃতিবিশিষ্ট জটলা তৈয়ার হইয়া সমুদ্রজলে হয় বহুকোষী জীব-এর আবির্ভাব।
উদ্ভিদ ও জীব
আজ হইতে প্রায় একশত কোটি বৎসর আগের কথা। তখন ভূপৃষ্ঠের কোথায়ও গাছপালা বা জীবজন্তুর চিহ্ন নাই। সমুদ্রের জল লবণহীন, কিছুটা গরম এবং উহাতে মিশিয়া আছে নানাবিধ জৈবাজৈব পদার্থ, অধিকাংশই কার্বন-ডাই-অক্সাইড। আকাশ ঘন কুয়াশায় ভরা, যেহেতু তখনও আকাশের সমস্ত জলীয় বাষ্প বৃষ্টির আকারে ঝরিয়া পড়ে নাই। কাজেই ভূপৃষ্ঠের কোথায়ও অবাধে সূর্যের আলো পৌঁছে না। বাতাসে অক্সিজেন নাই বলিলেই চলে, আছে প্রচুর কার্বন-ডাই অক্সাইড। এহেন অবস্থার মধ্যে সমুদ্রের জলে অতি ধীরে ধীরে চলিতেছিল জীবাণুদের বংশবিস্তার।
কালক্রমে পৃথিবী আরও শীতল হইয়া আকাশের সমস্ত জলীয় বাষ্প প্রায় নিঃশেষে ঝরিয়া পড়িলে, সূর্যালোক অবাধে ভূপৃষ্ঠে পতিত হইতে থাকে এবং সূর্যালোক পাইয়া জীবাণুরাজ্যে এক নবজাগরণের সাড়া পড়িয়া যায়।
শীতের দিনে ভোরের রৌদ্র সকলেই ভালোবাসে। কিন্তু উহা উপভোগ করিবার সুযোগ সকলে। পায় না। আবার রোদ পোহাইলে আরাম পাওয়া যায় বটে, কিন্তু উহাতে পেট ভরে না। রোদ পোহাইলে যদি পেট ভরিত, তাহা হইলে খাদ্য সংগ্রহের ঝঞ্ঝাট না করিয়া জীবেরা আজীবন রোদ পোহাইত। সাগরের জলে রৌদ্র পড়িলে যে সকল জীবাণু উহা উপভোগ করিবার সুযোগ পাইল, তাহারা একটি আশ্চর্য সুবিধা পাইয়া গেল। উহারা দেখিল যে, রোদ পোহাইলে পেট ভরে। সুতরাং উহারা নড়াচড়া না করিয়া সংবৎসর শুধু রোদ পোহাইয়া দেহ পুষ্ট ও বংশবৃদ্ধি করিতে লাগিল। এইরূপ সুবিধাভোগী জীবাণুরা হইল উদ্ভিদ। আর যে সকল জীবাণু সমুদ্রের গভীর জলে থাকিবার দরুন বা অন্য কোনো কারণে সূর্যালোকের সংস্পর্শ পাইল না, খাবার সংগ্রহের জন্য তাহাদের কিছু কিছু নড়াচড়া না করিয়া গত্যন্তর রহিল না। সূর্যদেবের শাপ এই সকল জীবাণুর বর হইল। অসুবিধাভোগী জীবাণুরা হইল জীব বা জন্তু। এই বিষয়টি আর একটু বিস্তারিতভাবে বলি।
আজকাল আমরা গাছপালার পাতায় যে সবুজ রঙের বাহার দেখি, উহা রঙের বাহার মাত্র নহে। গাছের পাতায় সূর্যালোক পতিত হইয়া সবুজ রঙের একটি প্রলেপ পড়ে। উহাকে বলে ক্লোরোফিল। ক্লোরোফিল পদার্থটির একটি বিশেষ ক্ষমতা এই যে, উহা বাতাসের কার্বন-ডাই অক্সাইডকে ধরিয়া উহার কার্বন ও অক্সিজেনকে দুই ভাগে বিভক্ত করে এবং কার্বনকে গাছের দেহপুষ্টির জন্য রাখিয়া অক্সিজেনকে বাতাসে ফিরাইয়া দেয়। যে সকল জীবাণুর দেহে সূর্যালোক পতিত হইল, তাহাদের শরীরে জন্সিল ক্লোরোফিল এবং উহার সাহায্যে জীবাণুরা বসিয়া বসিয়া খাবার খাইয়া অচল জীবন যাপনে অভ্যস্ত হইল। ইহারা জাতিতে হইল উদ্ভিদ। পূর্বেই বলিয়াছি যে, ঐ সময়ের বাতাসে ছিল প্রচুর পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড। তাই উদ্ভিদাণুরা অনায়াসে অতিমাত্রায় পুষ্টিকর খাদ্য কার্বন পাইয়া দ্রুত বংশবৃদ্ধি করিতে থাকে এবং বিবর্তনের ধারা অনুসারে নানা শ্রেণীতে বিভক্ত হইয়া ক্রমোন্নতির পথে আগাইয়া চলে। বিবর্তনের প্রথম ধাপে দেখা যায় শেওলা জাতীয় বিবিধ নিম্নশ্রেণীর জলজ উদ্ভিদ।
যে সকল জীবাণু সূর্যালোক হইতে বঞ্চিত রহিল, তাহারা অন্য উপায়ে কার্বন সংগ্রহের চেষ্টায়। থাকিল। উদ্ভিদাণুর দেহে প্রচুর কার্বন মজুত পাইয়া জীবাণুরা উহাদের আত্মসাৎ করিতে লাগিল। তৈয়ারী খাবার সবসময় মুখের কাছে থাকে না, উহা খোঁজ করিতে হয় এবং যদিও দুই-একটি মুখের কাছে ভাসিয়া আসে, তবুও উহাকে খাইয়া ফেলিলে কিছুদূর না আগাইয়া আর একটি পাওয়া অসম্ভব। তাই জীবাণুরা খাবার সংগ্রহের তাগিদেই কিছু কিছু চলাফেরায় অভ্যস্ত হইল। বিশেষত উদ্ভিদাণুদের খাইয়া খাইয়া জীবাণুদের রাক্ষুসেপনা বাড়িয়া গেল। সবল জীবাণুরা দুর্বল জীবাণুদের খাইতে আরম্ভ করিল। ইহাতে আর একটি ফল হইল এই যে, শিকারী চায় ধরিতে আর শিকার চায় পালাইতে, কাজেই আক্রমণ ও আত্মরক্ষার জন্য জীবাণুরা দ্রুত চলাচলে অভ্যস্ত হইল এবং প্রচুর আয়াসলভ্য খাদ্য খাইয়া বিবর্তনের ধারামতে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হইয়া ক্রমোন্নতির পথে দ্রুত অগ্রসর হইতে লাগিল। ইহাদের বিবর্তনের প্রথম ধাপে দেখা যায় ট্রাইলোবাইট নামক কয়েক শ্রেণীর পোকা জাতীয় জলজ জীব।
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, মানুষ, পশু, পাখি ইত্যাদি জীব ও বৃক্ষ, লতা, তৃণাদি উদ্ভিদ –ইহারা সকলেই এককালে ছিল সাগরের জলের বাসিন্দা। উহাদের আকৃতি, প্রকৃতি, খাদ্য ও বাসস্থানের যত বৈচিত্র, তাহা ঘটিয়াছে ক্রমবিবর্তনের ফলে।