কলয়ডাল সলিউশনের আর একটি বিশেষ গুণ এই যে, জলে অন্য যে সব জৈব-অজৈব পদার্থ থাকে, উহাকে আত্মসাৎ করিয়া নিজ দেহ পুষ্ট করিতে থাকে। এইভাবে লক্ষ লক্ষ বৎসর অতিবাহিত হইলে কলয়ডাল জৈব পদার্থটি আয়তনে ও ওজনে বহুগুণ বৃদ্ধি পায় ও শেষে ফাটিয়া দুই টুকরা হইয়া যায়। কিন্তু দুই টুকরা হইয়া উহারা মরে না, আলাদা আলাদা থাকিয়া আগের মতোই পুষ্ট হইতে থাকে এবং কালক্রমে আবার দুই টুকরা ফাটিয়া চারি টুকরা হয় ও কালে চারি টুকরা ফাটিয়া আট টুকরা হয়। এইভাবে চলিতে থাকে কলয়ডাল পদার্থটির পুষ্টি ও বংশবৃদ্ধির ধারা। এইখানে লক্ষ্যণীয় এই যে, কলয়ডাল পদার্থটির মধ্যে জীবন-এর সর্বাপেক্ষা বড় দুইটি লক্ষণ প্রকাশ পাইয়াছে– একটি পুষ্টি, আর একটি বংশবিস্তার। এই বিশেষ ধরণের কলয়ডাল পদার্থটির নাম প্রোটোপ্লাজম বা সেল (Cell), বাংলায় বলা হয় জীবকোষ।[২৪]
বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, আদিম সমুদ্রের জলে অতি তুচ্ছ প্রোটোপ্লাজম বিন্দুকে আশ্রয় করিয়াই হইয়াছিল প্রাণ-এর অভ্যুদয় এবং জগতে জীবন-এর অভিযান শুরু।
.
# কৃত্রিম উপায়ে প্রাণসৃষ্টি
প্রকৃতিরাজ্যে আদিম প্রাণসৃষ্টি সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক মতবাদের যে আলোচনা করা হইল তাহাতে বুঝা যায় যে, ‘প্রাণ’ শক্তিটি কোনো কোনো পদার্থের সম্মিলিত রাসায়নিক ক্রিয়ায় উদ্ভূত একটি অভিনব শক্তি। এইখানে একটি প্রশ্ন আসিয়া থাকে যে, প্রকৃতিরাজ্যে রাসায়নিক সম্মিলনে এখনও কি প্রাণের সৃষ্টি হইয়া থাকে? ইহার উত্তরে বিজ্ঞানীগণ বলিয়া থাকেন– না। কেননা, তখনকার পৃথিবীর প্রাকৃতিক অবস্থা এমন এক পর্যায়ে ছিল অর্থাৎ তাপ, আলো, বায়ুচাপ, জলবায়ুর উপাদান ইত্যাদির পরিমাণ এরূপ ছিল, যাহাতে তখন প্রাণের উদ্ভব সম্ভব হইয়াছিল। কিন্তু সেই আদিম অবস্থা এখন আর নাই এবং ভবিষ্যতেও তাহার পুনরোদ্ভব হইবার সম্ভাবনা নাই। এখন চলিতেছে বীজোৎপন্ন প্রাণপ্রবাহ অর্থাৎ প্রাণ হইতে প্রাণের উদ্ভবের ধারা। তবুও অনেকদিন হইতে বিজ্ঞানীগণ ভাবিতেছিলেন যে, কৃত্রিম উপায়ে অবস্থান্তর ঘটাইয়া প্রাণ সৃষ্টি করা যায় কি না?
কৃত্রিম উপায়ে প্রাণসৃষ্টি ও চন্দ্রলোকে গমন করা মানুষের পক্ষে সম্ভব কি না, তাহা লইয়া আলোচনা হইয়াছিল কয়েক বৎসর পূর্বে বিজ্ঞানীদের এক সম্মেলনে এবং আলোচনায় স্থির হইয়াছিল যে, উহা সম্ভব। অতঃপর অনেক বিজ্ঞানী গবেষণা চালাইতে থাকেন উহা বাস্তবায়নের জন্য। বিষয় দুইটির লক্ষ্যবস্তু হইল পরস্পর বিপরীতমুখী। উহার একটি হইল বহির্জগতে সুদূর মহাকাশে অবস্থিত এবং অপরটি হইল জীবের অন্তর্জগতে, একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত। এই বিষয় দুইটি লইয়া দুই দল বৈজ্ঞানিকের মধ্যে চলিতে থাকিল অতিদূর ও অতিনিকটের রহস্যোদঘাটনের পাল্লা।
যাঁহাদের গবেষণার পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণাদি বহির্মুখী অর্থাৎ আকাশ-মহাকাশ জুড়িয়া যাহাদের কর্মক্ষেত্র, তাহাদের গবেষণার যাবতীয় সংবাদ দৈনিক, মাসিক ও বেতারাদিতে ব্যাপক প্রচারের ফলে পৃথিবীময় তুমুল হৈ চৈ পড়িয়া গিয়াছিল অনেক বারেই। কোনো মানুষের কাছে এখন আর উহা অজানা আছে বলিয়া মনে হয় না। বিশেষত টেলিভিশন যন্ত্রযোগে চন্দ্রাভিযানের দৃশ্য স্বচক্ষে দেখিয়াছেন হাজার হাজার লোকে। পক্ষান্তরে, যাহারা প্রাণসৃষ্টি সম্বন্ধে গবেষণা করিতে থাকেন, তাহাদের গবেষণার পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণাদি হইল অন্তর্মুখী, অর্থাৎ গবেষণাগারেই সীমাবদ্ধ এবং জনসাধারণের দৃষ্টিসীমার আড়ালে অবস্থিত। বিশেষত চন্দ্রাভিযানের সংবাদের ন্যায় প্রাণসৃষ্টির সংবাদ তত ব্যাপক আকারে প্রচারিত হয় নাই। তাই কৃত্রিম উপায়ে প্রাণসৃষ্টি’ –এই বিষয়টি অনেকেই অবগত নহেন। কিন্তু প্রাণ সৃষ্টির অভিযান সফল হইয়াছে চন্দ্রাভিযান সফল হইবার প্রায় দেড় বৎসর পূর্বে।
১৯৬৭-৬৮ সালের শীতকালে (ডিসেম্বর-জানুয়ারি) ক্যালিফোর্নিয়ার। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডক্টর আর্থার কোর্ণবার্গ এবং তাহার সহকারীগণ মিলিয়া টেস্টটিউবে অজৈব পদার্থ C, H, ০, N ইত্যাদির সংমিশ্রণে জৈব ভাইরাস সৃষ্টি করিতে সক্ষম হন। উক্ত ভাইরাস প্রকৃতিজাত (আল্লাহর সৃষ্টি) জীবন্ত ভাইরাসের ন্যায় নড়াচড়া করে। ইহাতে বহুকালের বৈজ্ঞানিক কল্পনা বাস্তবে পরিণত হয়। [ লাইফ ইন এ টেস্টটিউব, দি এ্যামেজিং ওয়ার্লড অফ নেচার, ডোনাল্ড, পৃ. ২৩০]
আলোচ্য আবিষ্কারটি হইল বিজ্ঞানীদের প্রযোজিত জীবননাট্য অভিনয়ের মাত্র প্রথম অক। ইতঃপূর্বে ১৮২৮ খ্রী. জার্মান বৈজ্ঞানিক ফ্রেড্রিক ওহলার টেস্টটিউবে ইউরিয়া (একটি জৈব পদার্থ) তৈয়ার করিয়া প্রমাণ করিয়া দেন, প্রকৃতির ন্যায় মানুষ জৈব পদার্থ তৈয়ার করিতে পারে। জানি না, ইহার যবনিকা কত দূরে। সে যাহা হউক, এখন অভিজাত প্রাণের বিবর্তন সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা যাক।
.
# প্রাণের বিবর্তন
প্রাক-ক্যাম্ব্রিয়ান যুগের শেষের দিকের কথা। তখন আকৃতি ও প্রকৃতিতে সেল বা জীবকোষগুলি জীব পদবাচ্য নহে। কিন্তু উহাতে জীবনের প্রধান দুইটি লক্ষণ যখন প্রকাশ পাইয়াছে, তখন উহাকে আর নির্জীবও বলা চলে না। জীবকোষগুলির কোনো ইন্দ্রিয় নাই, বিশিষ্ট কোনো চেহারা নাই, আহার করে সর্বশরীর দিয়া চুষিয়া। পর্যাপ্ত পুষ্টিকর আহার পাইলে অতিদ্রুত বংশবৃদ্ধি করিতে পারে। শরীরের কোনো এক স্থানে আঘাত পাইলে সর্বশরীর শিহরিয়া উঠে। ইহাতে দেখা যায় যে, জীবকোষে জীবনের আর একটি লক্ষণ প্রকাশ পাইয়াছে– বোধশক্তি।